পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ও এশিয়ার অন্য দেশে নেসলের নিডো, সেরেলাকে অতিরিক্ত চিনি থাকে
সব শিশু সমান নয়, অন্তত বহুজাতিক সংস্থা নেসলের চোখে তো নয়ই, এমনটাই জানাচ্ছে সুইজারল্যান্ডের একটি অনুসন্ধানী সংগঠন পাবলিক আই এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দরিদ্র দেশে বাজারজাত করা নেসলের শিশুখাদ্য – দুধ ও সিরিয়াল পণ্যে পাওয়া গেছে চিনি ও মধু। অথচ, শিশুদের মুটিয়ে যাওয়া ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ এসব উপাদান, যা আন্তর্জাতিক গাইডলাইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ ইউরোপে বাজারজাত করা পণ্যের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা করেনি নেসলে।
বাংলাদেশে সেরেলাকের পরিবেশন প্রতি চিনিযুক্ত রয়েছে ৩.৩ গ্রাম। চিনির কথা প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকলেও– একারণে শিশুস্বাস্থ্যের যেসব ঝুঁকি তৈরি হয় সেগুলো ঘোষণা করা হয়নি।
শিশুখাদ্যের আরেকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড নিডো-ও একই কাজ করেছে।
পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে, ভারত ও পাকিস্তানে বিক্রি করা নিডোর পণ্যে চিনির পরিমাণ (পরিবেশন প্রতি) ২.৭ গ্রাম। যদিও পাকিস্তানে বিক্রি হওয়া পণ্যের প্যাকেটে এটার উল্লেখ নেই।
প্রক্রিয়াজাত এসব শিশুখাদ্যে পরিবেশন প্রতি সবচেয়ে বেশি বা ৬.৮ গ্রাম চিনি পাওয়া গেছে নাইজেরিয়ায়, তারপরেই রয়েছে সেনেগাল ও ভিয়েতনাম।
একইসময়ে যুক্তরাজ্য-সহ ইউরোপে প্রধান প্রধান বাজারগুলোয় নেসলে তাদের ছোট্ট শিশুদের ফর্মুলায় বাড়তি চিনিযুক্ত করেনি। যদিও একটু বড় বা চার থেকে আট বছর বয়সী বাচ্চাদের সিরিয়ালে কিছুটা চিনিযুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু ছয় মাস থেকে একবছর বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি পণ্যে তা একেবারেই রাখা হয়নি।
সে তুলনায়, বাংলাদেশে বাজারজাত করা পণ্যে তারা যেভাবে চিনিযুক্ত করছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। কারণে, দেশে অতিরিক্ত মুটিয়ে যাওয়ার বা স্থূলতার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ ও খাবারে লবণ ও চিনির ক্ষতিকর বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, "বাচ্চাদের খাবারকে আরো বেশি টেস্টি করার জন্য চিনি ও মধু মেশানো হচ্ছে। এই অ্যাডিশনাল সুগার খেলে বাচ্চাদের ওজন বেড়ে যায়। পাশাপাশি বাচ্চারা অতিরিক্ত মিস্টি স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে চিনি কম খেতে পারে না তারা, কম মিষ্টিযুক্ত কোন খাবার তাদের পছন্দ হয় না। এটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদে এসব দুধ বা খাবার খাওয়ার পর বাচ্চাদের ওজন বাড়বে, এবং বিভিন্ন ধরণের অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়বে।"
তিন বছরের কম বয়সী শিশুখাদ্যে চিনি বা মিষ্টিকারক উপাদান যুক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো নীতিমালা নেই। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে এটিকে ইউরোপীয় অঞ্চলের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে– এই দিকনির্দেশনা পুরো বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য বলেই মনে করা হয়।
তবে ডা. সোহেল মনে করেন, শিশুখাদ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় নীতিমালা থাকাও অতি-জরুরী।
তিনি বলেন, "রোগব্যাধির ঝুঁকি এড়াতে কোন খাবারে কতটুকু চিনি বা লবণ দেয়া যাবে– বাইরের বিভিন্ন দেশে তার একটা সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু, আমাদের দেশে তো সে ধরণের কোন নিয়ম নেই। আমাদের প্রক্রিয়াজাত প্যাকেজফুডে কতটুকু চিনি, লবণ থাকবে তার কোন নীতিমালা নেই।"
এবিষয়ে আনুষ্ঠানিক নীতিমালার জন্য তাঁরা বিশেষজ্ঞরা বহুবার আহ্বান জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"প্যাকেজ ফুডে চিনি ও লবণের স্ট্যান্ডার্ড পরিমাণ ঠিক করে দেয়া দরকার। আমরা ফুড সেফটি অথোরিটি ও বিএসটিআইকে বারবার বলছি যাতে খাবারে লবন-চিনির পরিমাণ যেন নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি না থাকে। যদি চিনি ও লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া না যায়- তাহলে যেন ওয়ার্নিং সাইনে উল্লেখ থাকে যে, এসব খাবারে লবণ বা চিনি অতিরিক্ত আছে। ক্রেতারা তখন নিজ উদ্যোগে সেসব খাবার খাবে বা খাওয়া থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু, এখন যেভাবে আছে তাতে তো মানুষ না জেনেই অতিরিক্ত লবণ ও চিনি খাচ্ছে"- যোগ করেন তিনি।
ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়ং চিলড্রেন নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইফতেখার রশিদ বলেন, "আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত খাদ্যমান, নির্দেশিকা এবং অনুশীলন কোডের একটি সংকলন– কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিয়াস (খাদ্য কোড) খাদ্য আমদানির সময় বজায় রাখার জন্য ইতিমধ্যেই প্যারামিটার নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশসহ ৫০টি দেশ এসব প্যারামিটার অনুসরণ করে। যার আওতায় প্রতিটি পণ্যকেই ব্যাপকভাবে টেস্টিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।"
বাংলাদেশে নবজাত ও এক থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের খাদ্য বাজারজাত ও বিপণনকারী একটি কোম্পানি- বেবি নিউট্রিশনেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রশিদ। তিনি এটাও বলেন যে, খাদ্য সংস্কৃতি বা রুচিতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে পার্থক্য থাকে।
"কোকাকোলাকে সবচেয়ে স্ট্যান্ডার্ডাইজড পণ্য হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু এশিয়ার চেয়ে ইউরোপের কোক কম মিষ্টি। আবার মধ্যপ্রাচ্যে বিপণন করা কোক আরো বেশি মিষ্টি।"
তাই স্থানীয় চাহিদা অনুসারে, প্রত্যেক দেশের নিজস্ব নীতিমালা করা দরকার বলে মনে করেন ইফতেখার রশিদ।
শিশুখাদ্যে অতিরিক্ত চিনি জাতীয় উপাদান থাকলে প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির সতর্কবার্তার লেবেল থাকা উচিত কি-না এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "এটা একটা স্থানীয় বিষয়। স্থানীয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এটা নির্ধারণ করা যেতে পারে। আইনে যদি লেবেল থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সব পণ্যের প্যাকেটা তা অবশ্যই রাখতে হবে।"
রশিদ আরও উল্লেখ করেন, দেশের বাজারে বিপণন করা পণ্যগুলো বিএসটিআই এর অনুমোদন করেছে, আর বিএসটিআই কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিয়াস মেনে চলে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১১ অনুসারে, দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের প্রাদুর্ভাব ৩০ শতাংশ, অতিরিক্ত ওজন ১৮.৯ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতায় ভুগছেন ৪.৬ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যেই অতিরিক্ত ওজন/স্থূলতার প্রাদুর্ভাব কম ওজনের প্রাদুর্ভাবকে ছাড়িয়ে গেছে।