জোড়াতালির সমাধান: রাস্তা উঁচু করে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ঠেকানো সম্ভব?
চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারের আব্দুল হাকিম সওদাগর লেনের এক দোকান মালিককে তার দোকানের সামনের দেওয়ালটি আরও উঁচু করতে দেখা গেল।
কারণ হিসেবে মনসুর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের স্বত্ত্বাধিকারী মো. আলী আকবর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানালেন, "বৃষ্টির সময় পানি ঢুকে দোকানের দুটি ফ্রিজসহ অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সড়কের উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে দোকানের সামনের দেওয়ালের উচ্চতা বাড়াচ্ছি।"
শুধু আলী আকবর একই নন, এরকম পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন এই এলাকার অনেকেই।
গত ৩০ মে বিকালে আব্দুল হাকিম সওদাগর লেনে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় অন্তত তিনটি ভবনের সামনে প্রতিরোধক (পানি আটকাতে ব্যবহৃত) দেওয়ালের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ চলছে। কারণ ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের সময় এখানকার অনেক ভবনেই পানি ঢুকে পড়ে।
জলাবদ্ধতা ঠেকাতে গেল মে মাসের শুরুতে রাস্তাটিকে প্রায় আড়াই ফুট উঁচু করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে সিটি কর্পোরেশনের এমন পদক্ষেপ কতটা দূরদর্শী ও দীর্ঘমেয়াদী— তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা।
গত দুই দশক ধরে, নগরীর নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা ঠেকাতে রাস্তা উঁচু করাই ছিল সিটি কর্পোরেশনের প্রাথমিক উপায়; আবদুল হাকিম সওদাগর লেন তারই সাম্প্রতিক উদাহরণ।
রাস্তা উঁচু করায় যদিও বন্যা থেকে সাময়িক পরিত্রাণ মিলেছে— তবে বৃষ্টির সময় এখানকার দোকানপাট, বাসা-বাড়িগুলোর নিচতলায় এখন আগের তুলনায় পানি ঢুকছে বেশি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা।
এখানকার আরেক বাসিন্দা ইকবাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "গত ২০ বছরে সংস্কার করে রাস্তার উচ্চতা ৬-৭ ফুট পর্যন্ত বাড়িয়েছে সিটি করপোরেশন। এখানকার অধিকাংশ বাড়ির নিচতলা এখন আর ব্যবহার উপযোগী নেই। নতুন ভবনগুলো রাস্তা থেকে উঁচু করে নির্মাণ করা হচ্ছে।"
নগরীর হালিশহর, পাহাড়তলী, ডবলমুড়িং, খুলশী, দামপাড়া, মেহেদীবাগ, বাকলিয়া, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, বাদুরতলা, বহাদ্দারহাট, শুলকবহর এলাকার পুরাতন ভবনগুলোর নিচতলা মূল সড়ক থেকে কয়েক ফুট নিচে। অনেক এলাকায় সড়ক থেকে কয়েক ফুট নিচে নেমে গেছে দোকানপাট। সংকুচিত অলিগলি ছাড়াও আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা বা পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় অনেক ভবনের নিচতলা অনেকাংশে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও নিচতলার সিঁড়ির ৮-১০ ফুট অংশও ভরাট করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নকে উৎসাহিত করার ফলাফল হলো শহরের এই জলাবদ্ধতার সমস্যা। অন্যদিকে, সড়ক উঁচু করার মতো জোড়াতালি সমাধানের মাধ্যমে জলাবদ্ধাতার সমস্যাকে দীর্ঘমেয়াদে আরও প্রকট করা হয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)- এর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে সড়ক উঁচু করা কোনো সমাধান হতে পারে না। সড়ক উঁচু করলে আশেপাশের ভবন বা স্থাপনাগুলোতে পানি আটকে থাকে। ফলে পানি নিষ্কাশনে সময়ও বেশি লাগে।"
তিনি বলেন, "উঁচু করার মাধ্যমে সড়ককে এক ধরনের বাঁধে পরিণত করা হয়েছে— যা জল নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে বাঁধা হিসেবেও কাজ করছে। অনেক এলাকায় সড়ক উঁচু করতে গিয়ে ক্রস ড্রেনগুলোকে কবর দেওয়া হয়েছে। ফলে ড্রেনেজ সিস্টেমও অর্কাযকর হয়ে পড়ছে।"
চসিকের তথ্যমতে, নগরীতে ২৭৪৭টি সড়ক রয়েছে— যার দৈর্ঘ্য ১১৯৫.৫ কিলোমিটার। এরমধ্যে পিচঢালা ৮৫৯ কিলোমিটার, কংক্রিটের ৩৩০ কিলোমিটার এবং কাঁচা সড়ক ১৫.৫ কিলোমিটার। এসব সড়ক উঁচু, সংস্কার বা মেরামতের পেছনে দুই খাত থেকে ব্যয় করে সংস্থাটি।
২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে সড়ক সংস্কার, মেরামত ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৫৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এরমধ্যে ভূমি, সড়ক, নর্দমা, কাটা রাস্তা খাতে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ২৭ কোটি এবং রাস্তা ও ফুটপাথ উন্নয়ন বাবদ ১২৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
একই সময়ে খাল, ছড়া, নর্দমা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ খাতে আরো ৩৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
এসব নিয়মিত ব্যয়ের বাইরেও প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে 'চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন'— শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৭৬৯ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়নের কাজ চলছে। গত দেড় বছরে প্রকল্পটির ৪৩০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে, যার বেশিরভাগই সড়ক সংস্কার ও উঁচু করার পেছনে ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পটির উপ-প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী জসীম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "মোট ৭৬৯ কিলোমিটার মধ্যে ২০-২৫ শতাংশ সড়ক উঁচু করা হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো কোনো সড়ক ২ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট পর্যন্তও উঁচু করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মূল সড়কের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে অলিগলির সড়কও উঁচু করা হচ্ছে।"
জোড়াতালি দিয়ে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান সম্ভব কিনা জানতে চাইলে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শাহীন-উল ইসলাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "পরামর্শক সংস্থার নকশা ও পরিকল্পনা অনুসারেই সড়ক উঁচু করা হচ্ছে। তারা সবকিছু বিবেচনায় নিয়েছে।"