সাবেক ডিএমপি-প্রধানের সম্পদ: আরেকটি হিমশৈলের চূড়া?
ফরিদপুরের গোপালপুল ইউনিয়নের বাসিন্দা নূর আলম। তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। নূর আলমের দাবি, কৃষিকাজ করে সংসার চালাতে বেগ পেতে হয় তার।
অথচ নথিপত্র বলছে, এই নূর আলমই গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রায় ২৬ বিঘা জমির মালিক। ফরিদপুরের আরেক বাসিন্দা ইব্রাহিম শেখেরও গাজীপুরে একই এলাকায় ৫ বিঘা জমি রয়েছে।
নূর আলম গাজীপুরে জমি কেনার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, 'আমি গাজীপুরে কোনো জমি ক্রয় করিনি। আমার সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। সেখানে জমি কিনব কীভাবে? আমি মিথ্যা বললে, আপনারা তদন্ত করে দেখেন। সম্পদ পেলে নিয়ে যান।'
এতে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে নূর আলমের নামে এই সম্পত্তি কিনল কে? ইব্রাহিম শেখই কীভাবে এত টাকার জমি কিনলেন?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নূর আলম ও ইব্রাহিম শেখের আরেকটি পরিচয় আছে—তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার আত্মীয়। নূর আলম সম্পর্কে আছাদুজ্জামানের শ্যালক এবং ইব্রাহিম তার ভাগ্নে।
ইব্রাহিম হোসেন বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। আমার মামা [আছাদুজ্জামান মিয়া] সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন। পারিবারিকভাবে তারা অনেক সম্পদশালী। সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনে একজন প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়াকে কেন্দ্র করে মামার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ তৈরি হয়। তারাই মামার নামে বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, নূর আলমও সচ্ছল পরিবারের সন্তান, তবে এখন তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। নূর আলমের সঙ্গে সঙ্গে অনেকদিন তার বোনের যোগাযোগ নেই, যার কারণে তিনি অসংলগ্ন কথা বলছেন।
তবে গাজীপুরের জমি-সংক্রান্ত সব প্রশ্নই এড়িয়ে গেছেন ইব্রাহিম শেখ। তিনি বলেন, 'আপনারা এলাকায় [ফরিদপুরে] আসেন, সব বুঝতে পারবেন।'
সম্প্রতি আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য সামনে এসেছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে একাধিক খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একের পর এক অনুসন্ধানে অভিযোগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সম্পদের সন্ধান পায়।
এ অবস্থায় প্রকাশিত খবরে উল্লেখিত সম্পদের তুলনায় আছাদুজ্জামানের প্রকৃত সম্পদ কত বেশি হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আছাদুজ্জামানের সম্পদের বিবরণী-সংক্রান্ত কিছু নথি বিভিন্ন মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি টিবিএসের কাছে এসেছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে সবগুলো নথির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
আছাদুজ্জামানের বিপুল সম্পদের বিষয়টি এমন এক সময় সামনে এল, যখন সাবেক আইজিপি বেজীজির আহমেদের বেশিরভাগ সম্পত্তি ক্রোক করেছেন আদালত। এছাড়া তার অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক।
জমি, ফ্ল্যাট ও কোম্পানি
সংবাদমাধ্যমের খবর এবং টিবিএসের কাছে আসা নথিগুলো বলছে, পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে, যার মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর প্লটে তার ২১ কাঠা জমি আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাছাড়া আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ ও ১৬৭ নম্বরে একটি ছয়তলা আলিশান বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিবেদন ও নথি অনুযায়ী, বর্তমানে বাড়িটি স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
এছাড়া আফরোজা জামানের নামে ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে তিনি বিশেষ কোটায় রাজউক থেকে একটি প্লট বরাদ্দ পান। অথচ রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই।
নথি অনুযায়ী, আফরোজা জামানের নামে গাজীপুর, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমির সন্ধান মিলেছে। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় তার নামে ১৩৭ শতাংশ জমি রয়েছে, যা কেনা হয়েছে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে।
২০২০ সালে একই এলাকার সাহারা মৌজায় ১৫ কাঠা জমি কেনেন তিনি। এছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় ৬০.৬০ একর জমি কেনেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিকুঞ্জ-১-এর ৮/এ রোডে আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহদীনের নামে একটি বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে।
স্ত্রীর নামে দুটি কোম্পানি
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় অন্তত দুটি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামান উভয় কোম্পানির অংশীদার এবং মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আসাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং টিবিএসের কাছে আসা নথি অনুসারে, তার আমলে মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেওয়া হয়।
এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান; তিনি আফরোজা জামানের সৎ ভাই। একসময় তিনি লেবার ভিসায় সৌদি আরবে গেলেও পরে বাংলাদেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন।
এছাড়া আফরোজা জামান শেফার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান। এ কোম্পানির পরিচালক আসাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে।
বক্তব্যের জন্য সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তার ফোন পাওয়া গেছে, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
তবে আছাদুজ্জামান সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সম্পদ কিনেছেন এবং বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সরকারকে বিব্রত করতে পরিকল্পিতভাবে এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
'আওয়ামী লীগ বিব্রত নয়'
সম্প্রতি দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক আইজিপি বেনজীরের বেশ কিছু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন আদালত।
এই অবস্থায় পুলিশের সাবেক ডিআইজি আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদ থাকার অভিযোগ এসেছে। তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব পদে অধিষ্ঠিত হন।
তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসায় তারা বিব্রত নন। এ সময় তারা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্সের' প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল টিবিএসকে বলেন, দুদকে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ গেলে দল যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সমর্থন দেয়। আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, দুদক স্বাধীনভাবে অভিযোগ তদন্ত করবে, দল কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ (স্বপন) বলেন, বেনজীরের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দুদকের কার্যক্রমে দল হস্তক্ষেপ করেনি। একইভাবে অন্য কোনো ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করবে না।
'অভিযোগ খতিয়ে দেখা উচিত'
আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের বিষয়ে দুদক তদন্ত করবে কি না, সে বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া দেননি দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। তাকে এসএমএসও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি।
তবে দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম বলেন, আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা উচিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
তিনি বলেন, 'পুলিশের শীর্ষ পদগুলো প্রায়শই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। আইন রক্ষার পরিবর্তে এই কর্মকর্তারা ভক্ষকে পরিণত হয়েছেন।'
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এরকম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকের প্রয়োজনীয় 'রিসোর্স' না-ও থাকতে পারে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প দুদকের আছে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া ইফতেখারুজ্জামান এসব বিষয়ে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।