৮ বছর ধরে ঝুলছে ‘ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান’, নতুন প্রকল্প নিতে চায় সিটি কর্পোরেশন
৮ বছর আগে, ২০১৬ সালে ঢাকা ওয়াসার তৈরি করা 'স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান ফর ঢাকা সিটি' নামে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন না করেই নতুন মাস্টার প্ল্যান নিতে যাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। দুই সিটি কর্তৃপক্ষের দাবি, বিদ্যমান ওয়াসার প্ল্যান অকার্যকর।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার ২৬টি খাল ও ড্রেন ঢাকা ওয়াসা থেকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর, ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী দুই সিটি কর্পোরেশন কোনো কাজ করেনি। ফলে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পরে গেল শুক্রবারের (১২ জুলাই) ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতার ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখেছেন নগরবাসী।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, "ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন শুধু ভুরি ভুরি প্ল্যান দিয়েই হবে না। প্ল্যানগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। প্ল্যান করে করে শুধু রাষ্ট্রের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে। সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে, তারা গত বছর নতুন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং খাল ও ড্রেনের উন্নয়ন শুরু করেছে। এর ফল পেতে একটু সময় লাগবে। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ২০১৬ সালে তৈরি করা মাস্টার প্ল্যান হালনাগাদ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পুনর্গঠন ও রূপান্তর করার প্রয়োজন উল্লেখ করে একটি প্রকল্পের আবেদন পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
ঢাকা ওয়াসার অপারেশনস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম শহীদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা ব্যর্থ বলেই তো সিটি কর্পোরেশনের কাছে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনই ঢাকা ওয়াসার মাস্টার প্ল্যান মানেনি, তাদের উন্নয়ন কাজের সময়। তারা ঢাকার সকল রাস্তায় ২-৩টা লাইন করেছে, কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসন করতে পারেনি। এখন যদি তারা মনে করে যে মাস্টার প্ল্যান মানবে না, তাহলে সেটিও তারা করতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা দুই সিটি কর্পোরেশনকেই মাস্টারপ্ল্যান দিয়েছি, কিন্তু তারা এটাকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা তাদের কাছে যাওয়ার পরে তারা বলছে, মাস্টারপ্ল্যান অকার্যকর।"
"সিটি কর্পোরেশন তো পাম্পগুলোকেই কার্যকর করতে পারেনি। একটি মাস্টারপ্ল্যান ১৫-২০ বছরের জন্য করা হয় এবং তা অন্তত ৫ বছর পর পর সংশোধন করতে হয় পরিস্থিতি আলোকে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, "আমরা শহরের মারাত্মক ক্ষতি করেছি, এখন হালকা বৃষ্টিতেও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন ঢাকা এলাকায় টেকসই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এখনও অগ্রগতি করার সুযোগ রয়েছে।"
"আমাদের হারানো ব্লু নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দরকার। সব সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় প্রচেষ্টার পাশাপাশি কমিউনিটিকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ না করে, কোনো মহাপরিকল্পনাই ঢাকাকে বাঁচাতে পারবে না।"
ঢাকা উত্তর সিটি ৮১.২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে করতে চায় ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ৮১.২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এর অর্থায়নে 'ইন্টিগ্রেটেড অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রিপেরাটরি ফ্যাসিলিটি ফর ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন' শীর্ষক কারিগরী সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়।
ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। রাজধানীতে দ্রুত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অল্প সময়ে অতি বৃষ্টিসহ বেশকিছু কারণ দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসার ২০১৬ সালে তৈরি করা মাস্টার প্ল্যান হালনাগাদ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পুনর্গঠন ও রূপান্তর করা জরুরি বলে দাবি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি।
ঢাকা উত্তর সিটিতে সীমিত সড়ক নেটওয়ার্ক, দখলের কারণে জলাশয়ের সংকুচিত হওয়া, ঝড়-বৃষ্টির সময় তীব্র জলাবদ্ধতা, পানি দূষণ, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বলে দাবি করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ২,৩,৬ এবং ১০ নং অঞ্চল কেন্দ্রিক— যা ৮৪ বর্গ কিলোমিটার জায়গা এবং ২৬টি ওয়ার্ডের আনুমানিক ১.৫৯ মিলিয়ন ভবন নিয়ে গঠিত। অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এবং দ্রুত বর্ধন ও উন্নয়নশীল। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।
ঢাকা উত্তর সিটির ড্রেনেজ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ টিবিএসকে বলেন, "ঢাকা ওয়াসা যে মাস্টারপ্ল্যান করেছিল, সে অনুযায়ী বর্তমানে কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ আমরা একটি আধুনিক ঢাকা গড়তে গেলে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। তবে আমরা ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যান থেকে যেসব বিষয় রাখা যায়, সেগুলো রাখবো।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, খালের প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং পানির আপ ও লোয়ার স্টিম অনুযায়ী ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করবো। এক্ষেত্রে আমরা নেচার বেইজড সল্যুউশনকে বেশি গুরুত্ব দেবো।"
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে, ঢাকায় দ্রুত নগরায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা টেকসই হচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "ওয়াসার মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব নয়, কারণ সেখানের ডিজাইন বর্তমান সম্মত নয়। আমরা ঢাকার চলমান উন্নয়ন কাজ এবং খাল ও জলাধার সংরক্ষণ করে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন চলমান রেখেছি। গতবছর থেকেই আমরা নতুন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ করছি।"
'স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান ফর ঢাকা সিটি' শীর্ষক প্ল্যানে ঢাকা শহরের স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ অবকাঠামোকে উন্নত করতে প্রায় ২৫০টি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০৪০ সালের মধ্যে ন্যূনতম নিষ্কাশনের মানদণ্ড পূরণের জন্য ডিজাইন করা এই প্রকল্পগুলোর মোট আনুমানিক খরচ দাঁড়াবে প্রায় ১৬,০০০ কোটি টাকা।
এই মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনটি ধাপে রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে— ২০১৫-২০২০, ২০২০-২০৩০, এবং ২০৩০-২০৪০। যদিও ২০১৫-২০২০ সালজুড়ে প্রথম পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত প্রকল্পগুলোর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।