জুলাই আন্দোলন দমনে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/12/476257468_944154067700291_422340479540706969_n.jpg)
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলো গত বছরের ছাত্র আন্দোলনের সময় ধারাবাহিকভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল।
আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য ও অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে উঠে এসেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও দমন-পীড়ন চালানোর জন্য একটি পরিকল্পিত নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। এতে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে জরুরি অপরাধ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি টিয়ারগ্যাস শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)।
র্যাব কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে তারা হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করেছেন। তবে তারা লাইভ ফায়ারের জন্য রাইফেল বা শটগান ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
প্রতিবেদনে এই ঘটনার আরও তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে এবং র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের তদন্তে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে, ওএইচসিএইচআর-এর সঙ্গে কথা বলা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, ১৯ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল। এর মধ্যে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর ও রামপুরার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথাও বলা হয়েছে, যেখানে এক ব্যক্তি আর্মার-পিয়ার্সিং গুলির টুকরার আঘাতে আহত হন। তিনি দাবি করেন, জলপাই-সবুজ রঙের একটি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছিল।
ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, তারা বিভিন্ন ভিডিও বিশ্লেষণ করলেও হেলিকপ্টার থেকে সরাসরি গুলি চালানোর কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পায়নি। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলিবিদ্ধদের কেউ কেউ হয়তো উঁচু স্থান থেকে ছোড়া গুলি, বাতাসে ছোড়া গুলি নিচে পড়ে আসা, অথবা প্রতিহত হয়ে আসা গুলির আঘাতে আহত হতে পারেন।
এছাড়া, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে এসব ঘটনার সময় সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখায় ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েনি, যা নিশ্চিত প্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
আন্দোলন মোকাবিলা এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে সরাসরি জড়িত থাকা সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে, কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা একটি বড় আকারের সিরিজ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তদারকি করেছিলেন। সেখানে নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা বাহিনী আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করত অথবা তাদের অকারণে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করত।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর আন্দোলনকারীদের ইচ্ছাকৃতভাবে এবং বেআইনিভাবে হত্যা বা আহত করার কিছু নিদর্শন রয়েছে। এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল, যেখানে লোকজনকে কাছ থেকে (পয়েন্ট ব্ল্যাংক) গুলি করা হয়েছিল।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য ও অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও দমন-পীড়ন চালানোর জন্য একটি পরিকল্পিত নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। এতে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে জরুরি অপরাধ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে রিপোর্ট করা মৃত্যুর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন মানুষ নিহত হতে পারে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, তাদের ৪৪ জন সদস্য নিহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আবু সায়েদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়েছে। ভিডিও, ছবি এবং জিওলোকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সত্য বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাকে ১৪ মিটার দূরত্ব থেকে অন্তত দুই বার শটগান দিয়ে গুলি করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনটি জানায়, প্রথমদিকে প্রতিবাদে অংশ নেওয়া নারীসহ অনেককে অকারণে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। প্রতিবাদে অংশ নেওয়া নারীদের বিরুদ্ধে শারীরিক আক্রমণ, ধর্ষণের হুমকি এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনী এবং পুলিশ শিশুরাও হত্যা ও আহত করেছে, তাদের অকারণে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে। ঢাকার ধানমন্ডিতে এক ১২ বছরের আন্দোলনকারী কিশোর ২০০টি শটগানের গুলি খেয়ে মারা যায়। নারায়ণগঞ্জে এক ছয় বছরের মেয়েকে আন্দোলন দেখতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়।
৫ আগস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে রক্তাক্ত দিনগুলোর একটি বলে প্রতিবেদনটি জানিয়েছে। একটি ১২ বছরের ছেলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে জানিয়েছিল, পুলিশ "বৃষ্টির মতো গুলি করছিল"। সে অন্তত দশটি মৃতদেহ দেখেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, নিরাপত্তা বাহিনী আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা পাওয়া থেকে বাধা দিয়েছিল। তাদের হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে। এছাড়া, হাসপাতালে সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ এবং চিকিৎসককে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ নেত্রীবৃন্দ, পুলিশ, মিডিয়া কর্মী ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, সাম্প্রদায়িক এবং আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলায় অনেকেই দায়মুক্তি পেয়েছে।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বাংলাদেশে একটি দল পাঠায়। এই দলে ছিলেন– মানবাধিকার তদন্তকারী, ফরেনসিক চিকিৎসক এবং অস্ত্র বিশেষজ্ঞ। তারা বিধ্বংসী ঘটনাগুলোর সম্পর্কে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করেন।
অন্তর্বর্তী সরকার তদন্তটির প্রতি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রদানে সাড়া দেয়, প্রয়োজনীয় প্রবেশাধিকার প্রদান করে এবং বিস্তৃত ডকুমেন্টেশন সরবরাহ করে।