চাকরির আশায় রাজনীতি করা রবিন আজ ফাঁসির অপেক্ষায়
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় যে ২০ জনের ফাঁসির রায় হয়েছে তাদের মধ্যে একজন হলেন মেহেদী হাসান রবিন।
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র রবিন ২০১৯ সালে আবরার হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। প্রায় দুই বছর আগে আবরার হত্যার ঘটনার পর রবিনের পরিবারের সাথে কথা বলেছিল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। সে সময় রবিনের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেনি তার পরিবার।
তবে রবিনের পরিবার ভাবেনি যে রাজনৈতিক পদ তাকে একটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিবে। বরং পরিবারের ধারণা ছিল, পড়াশোনা শেষ করার পর তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তাকে একটি ভালো চাকরি পেতে সাহায্য করবে।
রবিনের বাবা মাকসুদ আলি নিজেও রাজশাহীর কাটাখালি পৌরসভার একজন রাজনীতিবিদ। তিনি রাজশাহীর কাপাসিয়া গ্রামের ভারুয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং সে সময় আওয়ামী লীগের কাটাখালি শাখার ১ নং ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মাকসুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন, তার ছেলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা খারাপ কিছু নয়।
তিনি বলেন, "আমি নিজে রাজনীতি করি এবং আমার ছেলেও করে। আমাদের মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতারাও যুবক বয়সে রাজনীতি করেছেন। এভাবেই তারা আজকের রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন।"
তবে রবিনের বাবা বিশ্বাস করতেন, আবরার হত্যাকাণ্ডে তার ছেলের কোনো হাত নেই এবং তদন্তে রবিন নির্দোষ প্রমাণিত হবে্ন।
"আমার প্রত্যাশা, তদন্ত শেষ হলেই আমার ছেলে ফিরে আসবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করবে", বলেন মাকসুদ।
কিন্তু আদালতের রায়ে রবিনের বাবার সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে রবিনের একজন ভাবি বলেছিলেন, তিনি মনে করেন রবিনকে এই মামলায় ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে, তিনি কিছুতেই নিজের সহপাঠীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন না।
তিনি বলেন, "মানুষ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত হয় সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য। ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরেও অনেকে চাকরি পায় না। কিন্তু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলে চাকরি পাওয়া যায়।"
২৪ বছর বয়সী রবিন তার বাবা মাকসুদ আলি এবং মা রাশিদা বেগমের একমাত্র ছেলে। তার পরিবারের লোকজন তাকে শান্ত নামে ডাকে।
শান্ত নামের অর্থ যে ব্যক্তি ভদ্র এবং খুব চুপচাপ স্বভাবের। রবিনের পরিবারের দাবি, রবিনের এই নামের সাথে তার আচরণ পুরোপুরি মিলে যায়। স্থানীয়রাও তাকে একজন নম্রভদ্র ছেলে হিসেবেই চেনে, যে কিনা নিজের পড়ালেখা এবং অবসর সময়ে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
তারা আরও বলেছিলেন, রবিনের চরিত্রে সন্দেজনক কিছু লক্ষ্য করেননি তারা। তারা কোনোদিনই তাকে অন্যদের সাথে খেলতে বা গল্পগুজব করতে দেখেননি। ছুটিতে বাড়ি এসে রবিন সবার সাথেই বন্ধুর মতো আচরণ করতো এবং মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলতো।
তবে রবিন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একথা জানতে পেরে সে সময় বেশ অবাক হয়েছেন তার গ্রামের লোকজন। স্থানীয় ছাত্রলীগের সদস্যরা জানিয়েছিলেন, রবিনের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কথা তারা কেউই জানতেন না।
মাকসুদ আরও বলেছিলেন, তিনি তার ছেলের পড়ালেখার ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া ছিলেন। তিনি রবিনকে নজরদারিতে রাখার জন্য নিজের স্কুলেই ভর্তি করিয়েছিলেন।
রবিন পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী, দুই পরীক্ষাতেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান।
রবিনের বাবার ইচ্ছা ছিল তার ছেলে ডাক্তার হয়ে জনগণের সেবা করবে। কিন্তু রবিন তা চায়নি, সে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিল। তাই তার বাবা ছেলের ইচ্ছাকেই মেনে নেন।
"আমি প্রতি মাসেই তাকে টাকা পাঠাতাম, কিন্ত সে নিজেও ঢাকায় টিউশনি করিয়ে টাকা আয় করতো", বলেন মাকসুদ।
স্কুলে পড়ার সময় রবিনের সহপাঠী ছিলেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম। তার বাড়িও রবিনের একই গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকানোর পর তারা দুজন ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে ভর্তি হন।
রবিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিনহাজুল বলেন, "স্কুলে পড়ার সময় রবিন খুব শান্তশিষ্ট ও ভদ্র ছেলে ছিল। সে পড়াশোনার পেছনে অনেক সময় দিত। বুয়েটে চান্স পাওয়ার পরেও সে অহংকারী ছিল না। রবিন কোনোদিনই আমাকে বলেনি যে সে বুয়েটে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। বুয়েটের মতো স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার পরেও একজন ভালো ছাত্র এতটা অবাধ্য হতে পারে কিভাবে?"
মিনহাজুল বলেন, আবরার হত্যার দায় এদেশের রাজনীতিবিদদের নিতে হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, "বুয়েটের মধ্যে কি এমন আছে যা রবিনকে এরকম উচ্ছৃঙ্খল করে তুললো?"
রবিনের বাবা জানিয়েছিলেন, আবরারকে পিটিয়ে মারার দুদিন আগে (৫ অক্টোবর, ২০১৯) তার ছেলের সাথে তার কথা হয়েছিল।
ওই বছর ঈদের সময় রবিন তার গ্রামের বাড়িতে সাত দিন ছুটি কাটিয়েছেন। এর কিছুদিন পরেই দুর্গাপূজার ছুটিতে তার বাড়ি আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। কিন্তু রবিনের আর বাড়ি ফেরা হলো না। আবরার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে যান তিনি।