টার্মিনালের টম হ্যাংকসকে নিতে চাইলেও মুরাদকে কেন নয়?
প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়ার দুইদিনের মাঝে কানাডার টরন্টো পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালে হাজির হন ডা. মুরাদ হাসান। কিন্তু তাকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয় না ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। টরেন্টোর টার্মিনাল থেকে এই রাজনীতিবিদের জায়গা হয় দুবাইয়ের এক টার্মিনালে। সেখানেও একই পরিণতি।
কী, স্টিভেন স্পিলবার্গের দ্য টার্মিনাল (২০০৪) ছবিটির কথা মনে পড়ছে, তাই না?
টম হ্যাংকস অভিনীত এই জনপ্রিয় ছবিটি নির্মিত হয়েছিল কিন্তু বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে। মেহরান করিমি নাসেরি নামের একজন ইরানী ভদ্রলোকের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল এই সিনেমাটি।
ইরানের শেষ রাজা মোহম্মদ রেজা শাহের চক্ষুশূল হয়ে ১৯৭৭ সালে দেশ থেকে বিতাড়িত হন নাসেরি। তারপর একাধিক দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানালেও কোথাও গৃহীত হয়নি তার আবেদন।
এরপর জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তাকে উদ্বাস্তু ঘোষণা করলে ইউরোপের বেশ কিছু দেশে আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি পেয়ে যান নাসেরি। কিন্তু অনুমতি পাওয়ার পরই হয় বিপত্তি।
বিমানবন্দরে পাসপোর্টসহ যাবতীয় জরুরি নথি হারিয়ে ফেললে টার্মিনালেই আটকে যান এই ইরানী। ফ্রান্সের শার্লে দ্য গল বিমানবন্দরের টার্মিনালে দীর্ঘ ১৮ বছর পার করেন তিনি।
স্পিলবার্গের ছবির 'টার্মিনাল ম্যান', ভিক্টর নাভরস্কিও (টম হ্যাংকস) একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের টার্মিনালে পার করেন দীর্ঘ নয় মাস। মেহরানের মতো তিনিও এই টার্মিনালকে আপন করে নেন। তার খাওয়া, পড়াশোনা সব কিছুর সঙ্গী হয়ে উঠে টার্মিনাল।
নাভরস্কি ও মেহরান দুজনই শেষ পর্যন্ত টার্মিনাল ছেড়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। নাভরস্কির স্বপ্ন ছিল নিউ ইয়র্কের এক স্যাক্সোফোন বাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, যেই সুযোগ তিনি পান সিনেমার শেষে। মেহরানকে শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্বই দিয়ে বসে ফরাসি সরকার।
কিন্তু বাংলাদের 'টার্মিনাল ম্যান', মুরাদ হাসানের পরিণতি এতো সুখকর হয়নি। তবে বলে রাখা ভালো, উপরের দুজনের মতো সংগ্রাম করতে হয়নি তার, নিগৃহীতও হতে হয়নি তাদের মতো।
নাভরস্কি ও মেহরান যদি এক মেরুর 'টার্মিনাল ম্যান' হয়ে থাকেন, তাহলে মুরাদ অপর মেরুর। কোনো গৃহযুদ্ধ বা নিপীড়ক সরকারের থাবা থেকে বাঁচতে তিনি দেশ ছাড়েননি।
অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও একজন নায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে জনরোষের শিকার হওয়া ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগ করা এই নিন্দিত রাজনীতিবিদ দেশ ছাড়েন এক কথায় 'গা ঢাকা' দিতে।
কিন্তু মুখে কালো মাস্ক ও মাথায় কালো হুডি পরে লুকিয়ে লুকিয়ে টরেন্টো পর্যন্ত চলে গেলেও সেখানকার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলেন তাকে। টার্মিনাল থেকে বের করে দেওয়ার আগে তাকে জানানো হয়, নাগরিকদের আপত্তির জন্যই দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না তাকে।
এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেও একইভাবে বরখাস্ত হন মুরাদ। জানা যায়, টার্মিনাল থেকে টার্মিনালে ঘুরে শ্রান্ত মুরাদ আবেদন করেছিলেন আরও বেশ কয়েকটি দেশে। কিন্তু কেউই গ্রহণ করতে চাইছে না তাকে।
কিন্তু কেন তাকে কেউ গ্রহণ করতে চাইছে না?
এ ব্যাপারে ইমিগ্রেশন আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আজামালুল হোসেন কিউসি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কানাডা এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সে দেশের সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যখন কোনো বিদেশি নাগরিক সে দেশে সফর, পড়াশুনা বা কর্মসংস্থানের জন্য প্রবেশ করে, তার উপর কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি (সিবিএসএ) কঠোর নজরদারি রাখে।
"এক্ষেত্রে দুইটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয় তারা। ওই বিদেশি নাগরিকের প্রবেশের কারণে যদি কানাডা তথা কানাডায় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং তার দ্বারা কোনো সহিংসতা তৈরির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সিবিএসএ ওই বিদেশি নাগরিককে কোনোভাবেই দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয় না।"
কানাডা প্রবাসী এবং কানাডীয় এক ইমিগ্রেশন কনসাল্টিং কোম্পানির কর্ণধার এম এল গনি এ ব্যাপারে লিখেছেন, "বাংলাদেশের এক চিত্রনায়িকাকে তিনি যেভাবে হুমকি দিয়েছেন বলে অডিও ভাইরালে শোনা গেছে, তা যেহেতু ওই চিত্রনায়িকার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক, একই কারণে তা যে কোনো কানাডিয়ান নাগরিকের জন্যও বিপজ্জনক গণ্য করা যায়।"
অর্থাৎ, এক কথায়, কানাডিয়ানদের নিরাপত্তার জন্য মুরাদ হাসান হুমকিস্বরূপ, তাই তাকে জায়গা দেয়নি দেশটি। আরব আমিরাতও হয়তো একই কারণে টার্মিনাল ত্যাগ করতে দেয়নি তাকে।
এখন তার শেষ আশ্রয় বাংলাদেশ। তিন দিন টার্মিনালে ঘোরার পর রোববার সন্ধ্যায় মুখ লুকিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন মুরাদ।
এখানে তাকে টার্মিনালে আটকে থাকতে হয়নি। কানাডিয়ানদের নিরাপত্তার জন্য 'হুমকিস্বরূপ' এই ব্যক্তিকে ঢাকার টার্মিনালে আটকায়নি কেউ।
তবে চুপিসারে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করা এই সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে মামলা রুজু হচ্ছে। চলছে সমালোচনাও। মামলা-মোকদ্দমা ও লোকের নিন্দা মুরাদকে আবার টার্মিনালে ফিরিয়ে নিবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।