প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন লিটার ভূগর্ভস্থ পানির তৃষ্ণা বেজা-র, পরিবেশগত বিপর্যয়ের শঙ্কা
২০২০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম শিল্পনগরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ৩০ একর জমি বরাদ্দ পায় ম্যাকসন্স গ্রুপ। শিল্পগ্রুপটি সেখানে মেট্রো স্পিনিং মিলস নামে একটি ও ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস-এর দুটি ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করে। বস্ত্রখাতে এই কোম্পানির প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে শুধুমাত্র পানির সংস্থান না হওয়ার কারণে।
ম্যাকসন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফেরদৌস কায়সার মাসুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শিল্পনগরে এখনও পানি সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় নির্মাণকাজ ধীরগতিতে চলছে। পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে আমরা দ্রুত সেখানে কারখানা নির্মাণ শুরু করব।'
কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ৫০টি গভীর—প্রতিটি ৭০০ ফুট গভীর—নলকূপ বসানোর কাজ করছে। এসব গভীর নলকূপ ব্যবহার করে দৈনিক ৫০ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই মাসুদের কথায় এই সতর্কতার ছোঁয়া থাকার থাকার কথা ছিল না।
কিন্তু ম্যাকসন্স গ্রুপের এমডি আরও একটি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে ম্যাকসন্স গ্রুপের এমডি ফেরদৌস কায়সার মাসুদ বলেন, 'মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ এলাকায় একটি বড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নে পানির স্তর নিচে নেমে যায়।' এই বিষয় নিয়ে সম্প্রতি আন্দোলনে নামে স্থানীয়রা। ফলে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন শুরু হলেও এরকম আন্দোলন শুরু হবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
প্রাথমিকভাবে শিল্পনগরের জন্য হালদা নদী থেকে পানি আনার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা)। প্রতিদিন ১৫৪ মিলিয়ন লিটার পানি আনার পরিকল্পনা ছিলো প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু বাড়তে থাকা লবণাক্ততার কারণে হালদা নদী নিজেই সংকটে থাকায় সে পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসতে হয় বেজাকে।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক টিবিএসকে বলেন, 'আগামী ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহ নিশ্চিত হবে। এছাড়া এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প নেই।' তিনি দাবি করেন, বর্তমানে তাদের প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন লিটার ভূর্গস্থ পানি উত্তোলনের অনুমোদন রয়েছে, তবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য স্থানীয়দের যাতে পানির সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য বেজা প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন লিটারের বেশি পানি উত্তোলন করবে না।
এছাড়া পার্শ্ববর্তী খৈয়াছড়া ঝরনা থেকে পানি কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার জন্যও একটি সমীক্ষা করা হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া বৃষ্টির পানিও সংরক্ষণ করা হবে।
কিন্তু শিল্পনগরের পানির চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলছেন পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা। প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ বা ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য যেমন ক্ষুণ্ন হবে, তেমনি মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকিও বাড়বে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টিবিএসকে বলেন, 'ভূগর্ভস্থ পানি পাবলিক প্রপার্টি। এ পানি উত্তোলনের ফলে অবশ্যই সংকট তৈরি হবে। আশপাশের গ্রামের মানুষ পানি পাবে না।'
তিনি মন্তব্য করেন, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিবেশগত প্রভাবগুলো যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের এই পরিকল্পনা অবিলম্বে বাতিলের আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে, গত ৪০ বছরে চট্টগ্রামের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০ মিটার নেমে যাওয়ায় জেলার ৭৫ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পানি সংকটে ভুগছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ড. আনোয়ার জাহিদ টিবিএসকে বলেন, 'চট্টগ্রামে ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থান দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নয়। সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই শিল্পাঞ্চলের মাটি বেশ পাথুরে, আর তাই এখানে ভূগর্ভস্থ পানি জমে থাকে না।'
এখনই পানিবঞ্চিত বাড়িঘর, তৃষ্ণার্ত শিল্প
চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য মো. মোশাররফ হোসেনের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। ২০ বছর ধরে বাড়ির একমাত্র গভীর নলকূপটি থেকে পানি পান করছিল তার পরিবার। কিন্তু সম্প্রতি এই নলকূপটিতে আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সাংসদের বাড়ি নয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানি নিয়ে কষ্টে আছে মিরসরাই উপজেলার সাড়ে ৩ লাখ মানুষ।
চট্টগ্রামের ভারী শিল্পকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সীতাকুণ্ড ও তৎসংলগ্ন মিরসরাই। এ অঞ্চলে ৪০০-র বেশি ছোট-বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে বলে প্রতিটি শিল্প কারখানা ভুগছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেও কেবল পানি সংকটের কারণে বিপদে পড়েছেন তারা। কারখানা চালু রাখতে ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ভূপৃষ্ঠেও পানির অভাব রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে গত বছর মিরসরাইয়ে একটি ইস্পাত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলনের অভিযোগে সাংসদ মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আন্দোলনে নামে এলাকাবাসী।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কেবল মিরসরাই অংশেই ২০৩১ সাল নাগাদ দৈনিক পানির চাহিদা হবে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন লিটার। চলতি বছরেই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এখনও পরোপুরি নিশ্চিত হয়নি পানির সরবরাহ।
মিরসরাই উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, উপজেলায় সরকারিভাবে প্রায় ৩৩ হাজার নলকূপ ও শ্যালো পাম্প রয়েছে। এসব নলকূপের প্রায় ৪০ শতাংশে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বর্তমানে অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৭৫০ ফুটেরও বেশি নেমে যাওয়ায় ১৮৪টি গভীর নলকূপে পানি উঠছে না।
বাধাগ্রস্ত বিনিয়োগ
চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠছে দেশের বৃহত্তম শিল্পনগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর।
বেজার তথ্য অনুযায়ী, শিল্পনগরের মিরসরাই অংশে ১৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ হাজার ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫০ একর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলকে, ৫০০ একর বিজিএমইএ গার্মেন্টস ভিলেজকে, ৫০০ একর এসবিজি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে এবং ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপকে।
পানি চাহিদার সমাধান করতে না পেরে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয় বেজা। তবে এ কাজ করলে মিরসরাইয়ে পানির সংকট তীব্র হবে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
শিল্পনগরে প্লট বরাদ্দ পাওয়া বেশিরভাগ শিল্প গ্রুপের কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ থমকে আছে পানি সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ার কারণে। বেজা কর্তৃপক্ষ আপাতত ৩ বছর ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বেজার এই প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না কারখানা মালিকেরা। ফলে শিল্পনগরে অন্যান্য ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিত করার পরও কারখানা নির্মাণে তেমন একটা আগ্রহী না বিনিয়োগকারীরা।
পোশাক কারখানা নির্মাণের জন্য বেজা সম্প্রতি ৩টি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে ১৬ একরের প্লট বুঝে নিতে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু পানি সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কারখানা স্থাপনে এখনো উদ্যোগী হয়নি।
পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি রাবিকুল আলম চৌধুরী বলেন, 'গার্মেন্টস ভিলেজ এরিয়ায় এখনও পানি সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। আগে পানি সরবরাহ নিশ্চিত হোক, তারপর গার্মেন্টস মালিকরা সেখানে কারখানা নির্মাণ শুরু করবেন।'
বেজা সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহে ২০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। এই প্ল্যান অনুযায়ী, শিল্পনগরের মিরসরাই অংশে প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন লিটার পানি প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, এরপর ফেনী নদী এবং পরবতীতে মেঘনা নদী থেকে পানি উত্তোলনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তারা।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন রায় বলেন, কারখানাগুলোতে মাতামুহুরী নদী থেকে পানি সরবরাহ করতে পারলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমে আসবে।
তবে পরিবেশবিদরা ডিস্যালিনেশনের মাধ্যমে সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করে ব্যবহারোপযোগী করার পরামর্শ দিয়েছেন, যা পানি ব্যবহারোপযোগী করার সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত।