জুনে বসছে ৩ হাজার স্মার্ট মিটার, অটোমেশনে যাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা
চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক পানি উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ৪৫ কোটি লিটার। এরমধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অপচয় দেখানো হয় সিস্টেম লস বা নন-রেভেনিউ খাতে। বিপুল পানির অপচয় লিকেজের কারণে নাকি অবৈধ উপায়ে তা বিক্রিও হয়; এ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। দীর্ঘদিনের এ সংকট নিরসনে এবার বিলিং সিস্টেমকে অটোমেশন করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। পাইলট প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের জুন মাসে কয়েকটি এলাকায় ৩ হাজার পিওর আল্ট্রাসনিক ডিজিটাল মিটার বসানো হবে।
জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকেই অটোমেশনের দিকে যাওয়ার চিন্তা করছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। শুরুতে অ্যানালগ ও ডিজিটার দুটি ডিভাইস সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাবল কাটা পড়লে গোলমাল হতে পারে সেজন্য বিলিং সিস্টেম পরিচালনা করতে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ডিভাইস খুঁজছিল কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের শুরুর দিকে লোরা গেটওয়ে ভিত্তিক ৫টি স্মার্ট মিটার পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয়। নগরীর লালখানবাজার এলাকার হাইলেভেল রোড ও বাঘঘোনায় বসানো হয় এসব পরীক্ষামূলক মিটার। এক বছরের ব্যবহারে মিটারের কার্যকারিতার সফলতা পেয়ে পাইলট প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার তিনটি প্রকল্প ও গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে দৈনিক গড়ে পানি উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ কোটি লিটার। এর মধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে ১৪৩ মিলিয়ন লিটার, মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯০ মিলিয়ন লিটার পানি উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ৪৩টি গভীর নলকূপ থেকে ৬৮ মিলিয়ন এবং ৩৭ মিলিয়ন লিটার পানি উৎপাদিত হয়।
গত নভেম্বর মাসে প্রকাশিত সর্বশেষ এমআইএস প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মোট উৎপাদিত পানির ২৮ শতাংশ সিস্টেম লস বা নন-রেভেনিউ ওয়াটার। গত বছর এটি ছিল ২৯ শতাংশ। এ হিসেবে দৈনিক নন-রেভেনিউ পানির পরিমাণ প্রায় ১২ কোটি লিটার, যা পরিমাণের দিক থেকে মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্পের উৎপাদনের চেয়েও বেশি। বছরে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। একটি পানি উৎপাদন প্রকল্প প্রতিষ্ঠায় প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন সংস্থায় নন-রেভিনিউ ওয়াটারের পরিমাণ হয় মোট উৎপাদানের ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ।
২০২০ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার এক তদন্তে উঠে আসে, লিকেজ সমস্যার কারণে উৎপাদিত পানির ৩.৮৯ শতাংশ অপচয় হয়। বর্তমানে নগরীর ৫৭ ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহ করতে পারে সংস্থাটি। পানির অপচয় রোধ করা গেলে নগরীর ৭০ থেকে ৮০ ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহ করা সক্ষম হবে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এখনো বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখে বিল হিসাব করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ৪২ জন মিটার পরিদর্শক দিয়ে প্রায় ৭৮ হাজার সংযোগের বিল তৈরি করতে হয়। এসব কারণে পানির ব্যবহারের সঠিক হিসাব না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, ওয়াসা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিটার পরিদর্শকরা গ্রাহকদের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে রিডিং কম দেখান। টাকার বিনিময়ে অবৈধ সংযোগ দেন। ওই পানিগুলোকে নন-রেভিনিউ ওয়াটার নাম দিয়ে রাজস্ব আয় কম দেখানো হয়। ডিজিটাল মিটারের মাধ্যমে বিল হিসাব করা গেলে পানির অপচয় ও অবৈধ বিক্রি রোধ করা যাবে বলে আশা করছেন ওয়াসার কর্মকর্তারা।
সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ধরে নিলাম উৎপাদিত পানির ৭ শতাংশ লিকেজের মাধ্যমেই অপচয় হয়। তাহলে বাকি নন-রেভেনিউ ২০ থেকে ২১ শতাংশ পানি নিশ্চয় মানুষ সৃষ্ট ভুল অথবা মিটার রিডিংয়ের কারণে হয়। একজন মিটার পরিদর্শক ২,০০০ থেকে ২,৫০০ মিটারের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বে থাকেন। এটি আসলেই অনেক কঠিন। আশা করছি, প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে পানির অপচয় রোধ হবে। ওয়াসার রাজস্বও বাড়বে।"
জুনে মেহেদীবাগ-গোলপাহাড় এলাকায় বসবে ৩ হাজার স্মার্ট মিটার
পাইলট প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার মিটার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে গত ১১ জানুয়ারি দরপত্র আহ্বান করা হয়। অটোমেটেড মিটার রিডিং ফিচারের স্মার্ট ওয়াটার মিটার সরবরাহের পাশাপাশি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও পালন করতে হবে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে। পাইলট প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গত ৩০ জানুয়ারি দরপত্র গ্রহণও সম্পন্ন হয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নমুনা মিটার পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এরপর নির্ধারিত মানের মিটার তৈরির জন্য সময় দেওয়া হবে প্রতিষ্ঠানকে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে চলতি বছরের জুন নাগাদ ৩ হাজার সংযোগে স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হবে। শুরুতে নগরীর মেহেদীবাগ ও গোলপাহাড় এলাকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের বিলের হিসাব হবে এই ডিজিটাল মিটারে। এছাড়া, অনলাইনে বিল প্রদানের জন্য পেমেন্ট গেটওয়েও থাকবে ডিজিটাল এই সিস্টেমে। পাইলট প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সবগুলো সংযোগকে এর আওতাভুক্ত করা হবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার আইসিটি সার্কেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী শফিকুল বাসার টিবিএসকে বলেন, "অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লোরা গেটওয়ে ভিত্তিক মিটারের কার্যকারিতায় সফলতা পেয়েছি। দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে এখন। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে কার্যাদেশ দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে মিটার স্থাপনের জন্য।"