বড় প্রতিষ্ঠান যাতে অহেতুক সুবিধা না পায়, এসএমই'র সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব
কোনো প্রতিষ্ঠানের জমি ও ভবন ব্যতীত প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ স্থায়ী সম্পদের মূল্য ৩০ কোটি টাকার কম হলে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে মাঝারি শিল্প ও এর চেয়ে বেশি হলে বৃহৎ শিল্প ক্যাটাগরিভুক্ত করার প্রস্তাবনা দিয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সংজ্ঞায়ন জটিলতায় অনেক বৃহৎ শিল্প মাঝারি শিল্পভুক্ত হয়েছে, যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য দেওয়া নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা ভোগ করছে। আর বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও সক্ষমতার অভাবে বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প।
প্রণয়াধীন জাতীয় শিল্পনীতি-২০২১ এ কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) শিল্পের সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণে শিল্পমন্ত্রণালয়ে এই প্রস্তাবনা দিয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিক, যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়ন ও প্রসারে কাজ করছে।
এদিকে সিএমএসএমইএর সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ ও পরিমার্জনে স্থায়ী সম্পদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও একই মতামত দিয়েছে। পাশাপাশি বার্ষিক টার্নওভার ৩০ কোটি টাকার বেশি হলে বৃহৎ শিল্পভুক্ত করার মত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ফাউন্ডেশনের বলছে, বৃহৎ শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার হবে ৫০ কোটি টাকার বেশি। এর চেয়ে কম হলে মাঝারি শিল্পভুক্ত হবে। তবে বার্ষিক টার্নওভারের ভিত্তিতে শিল্পের ক্যাটাগরি না করার প্রস্তাবনা দিয়েছে বিসিক।
স্থায়ী সম্পদের ভিত্তিতে নতুন সংজ্ঞায়ন করা হলে বৃহৎ শিল্প মাঝারি শিল্প বর্হিভূত হবে, এতে উপকৃত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প।
ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠান ভোগ করার সাম্প্রতিক উদহারণ হচ্ছে সরকার ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ।
করোনা মহামারির ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার সিএমএসএমই খাতে স্বল্পসুদে এই প্রণোদনা ঘোষণা করে। তবে ব্যাংকের নানাবিধ শর্ত ও জটিলতার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নিতে পারেনি।
পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্থ প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার দ্বিতীয় দফায় ১৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়্যারম্যান ড. মোঃ মাসুদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "শিল্পনীতিতে সংজ্ঞায়ন জটিলতায় এসএমইরা উপকৃত হচ্ছে না। এসএমইদের সক্ষমতা ও বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারায় শিল্পের উন্নয়নে সরকারের দেওয়া নীতি-সহায়তা ও প্রণোদনা ভোগ করছে বড়রাই। আর ছোট ছোট উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে।"
ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে মাঝারি শিল্পে জনবল ১০১-২৫০ জন আর ২৫০ জনের বেশি হলে বৃহৎ শিল্প বিবেচনা করার মত দিয়েছে ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বিসিক জনবলের ভিত্তিতে শিল্পের ক্যাটাগরিভুক্ত করার বিপক্ষে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে জাতীয় শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয়। এই শিল্পনীতি অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের জমি ও ভবন ব্যতীত প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ স্থায়ী সম্পদের মূল্য ৫০ কোটি টাকার নীচে হলে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে মাঝারি শিল্প ও এর চেয়ে বেশি হলে বৃহৎ শিল্প ক্যাটাগরিভুক্ত হবে।
জাতীয় শিল্পনীতিতে মোটাদাগে মাইক্রো, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প এই চার ক্যাটাগরিতে শিল্পের সংজ্ঞায়ন করা হয়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের শিল্পনীতিতে প্রত্যেক ক্যাটাগরিতে আবার ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাত অর্ন্তভুক্ত ছিল। তবে প্রণয়াধীন শিল্পনীতিতে বিদ্যমান ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতের পাশাপাশি ট্রেডিং খাতকেও অর্ন্তূভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে ফাউন্ডেশন ও বিসিক।
এসএমই ফাউন্ডেশনের মতে, বর্তমান শিল্পনীতির কারণে যেসব বৃহৎ শিল্প ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পভুক্ত হয়েছে, তারা এই ক্যাটাগরি থেকে বেরিয়ে যাবে আর আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীর দেওয়া বিভিন্ন নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা ভোগ করতে পারবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, দেশে ৭৮.১৮ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৯.৯৩% প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই)। আর ০.০৭ শতাংশ বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
প্রণয়নাধীন জাতীয় শিল্পনীতি-২০২১-এ সিএমএসএমই'র সংজ্ঞা পরিমার্জনপূর্বক পুনঃনির্ধারণে শিল্পমন্ত্রণালয়কে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
এই চিঠিতে মাইক্রো, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে স্থায়ী সম্পদ, বার্ষিক টার্নওভার ও জনবলের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়ণের প্রস্তাব দিয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
২০১৬ সালের শিল্পনীতিতে শিল্পের সংজ্ঞায় জনবল ও বিনিয়োগসীমা ২০১০-এর নীতির চেয়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার ফলে অনেক বৃহৎ শিল্প ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে ফাউন্ডেশন শিল্প মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, "বৃহৎ অনেক প্রতিষ্ঠান এসএমই'র অর্ন্তভূক্ত হওয়ায়, তারাই সিএমএসএমই খাতের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। আর সিএমএসএমই খাতের প্রকৃত উদ্যোক্তারা সরকার প্রদত্ত ঋণ ও নীতি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।"
ওই চিঠিতে ফাউন্ডেশন জানিয়েছে "অন্যদিকে নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ন সহযোগীদের সিএমএসএমই খাতে সহায়তা প্রদানেও সমস্যা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রকৃত সিএমএসএমইদের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবা ও আর্থিক প্রণোদনা প্রাপ্তিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যার জন্য ২০১৬ শিল্পনীতির বিদ্যমান সংজ্ঞা পূর্ননির্ধারণ করা প্রয়োজন।"
বিদ্যমান শিল্পনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বৃহৎ শিল্প বলতে যেসব শিল্পের জমি ও কারখানা ব্যতীত স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ (Replacement cost) ৫০ কোটি টাকার অধিক ও জনবল ৩০০ জনের বেশি।
আর সেবা খাতে বৃহৎ শিল্পের স্থায়ী সম্পদ ৩০ কোটি টাকার অধিক ও জনবল ১২০ জনের বেশি।
তবে টার্নওভারের ভিত্তিতে শিল্প চিহ্নিতকরণ ও ট্রেডিং খাতকেও ২০১৬ সালের শিল্পনীতিতে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এবারের শিল্পনীতিতে ট্রেডিং খাততে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পের স্থায়ী সম্পদ ও জনবলের সংখ্যা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবনা হচ্ছে: ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বৃহৎ শিল্পের স্থায়ী সম্পদ হবে ৩০ কোটি টাকার বেশি ও জনবল ২৫০ জনের অধিক। সেবা খাতে মাঝারি শিল্পের স্থায়ী সম্পদ ১০ কোটি টাকার বেশি ও জনবল ১২০ জনের অধিক এবং ট্রেডিং খাতে বৃহৎ শিল্পের স্থায়ী সম্পদ ১৫ কোটি বেশি ও জনবল ১০০ জনের অধিক।আর এই তিন খাতের শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ কোটি টাকার বেশি হলেই বৃহৎ শিল্পভুক্ত হবে।
স্থায়ী সম্পদ ও জনবল মানদণ্ডের উর্ধ্বসীমার ভিত্তিতে পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত অনুযায়ী, স্থায়ী সম্পদ ১০ কোটি টাকা বেশি ও ৩০ কোটি টাকার নীচে এবং জনবল ১০১ জন থেকে ২৫০ জন হলে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে মাঝারি শিল্প। আর স্থায়ী সম্পদ ৩০ কোটি টাকার বেশি ও জনবল ২৫০ জনের বেশি হলে বৃহৎ শিল্প হবে।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, এই মানদন্ডে বিবেচনা করা হলে বর্তমানে মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসাবে বিবেচিত অনেক শিল্পই উচ্চতর ধাপে অন্তর্ভুক্ত হবে। মাঝারি অনেক শিল্প সিএমএসএমইর আওতা বহির্ভূত হয়ে বৃহৎ শিল্পভুক্ত হবে।
এছাড়াও ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতের পাশাপাশি ট্রেডিং ব্যবসাকেও মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের আওতায় সংজ্ঞায়নের মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, শুধুমাত্র দেশের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সংক্রান্ত কর্মকান্ডসমূহকে সিএমএসএমইর আওতাভুক্ত ট্রেডিং বা ব্যবসা হিসাবে বিবেচনা করা হলে তা আমদানি ব্যবসার সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে আওতাবহির্ভূত রাখতে, যা দেশীয় পণ্য উৎপাদনে জড়িত সিএমএসএমইসমূহকে পণ্য বিপননে সহায়তা ও উৎসাহ প্রদান করবে।