ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যায় ৪ জনের ফাঁসির রায়
বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলায় ৪ জনের ফাঁসি দিয়েছেন আদালত। অভিযুক্ত আরেক আসামিকে খালাস প্রদান করা হয়েছে।
বুধবার দুপরে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইবুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব এই রায় দেন। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ৪ জনকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
দণ্ডিতরা হলেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন, খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বিরেন্দ্রনগরের মামুনুর রশীদ ওরফে হারুন অর রশিদ ও কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ। এদের মধ্যে আবুল খায়ের ছাড়া বাকি সবাই পলাতক রয়েছেন।
রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে নগরের রিকাবীবাজার এলাকার সাফিউর রহমান ফারাবী ওরফে ফারাবী সাফিউর রহমানকে। ফারাবী ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার দণ্ডিত আসামি। আর সম্পূরক অভিযোগপত্রে নাম আসা ছয়জনের মধ্যে ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর মান্নান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইজীবী সন্তোষ প্রকাশ করলেও উচ্চআদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনীবীরা।
এদিকে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত উল্লেখ করেন, অনন্ত বিজয় বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ ছিলেন। তিনি ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। অনন্ত বিজয় দাশের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে প্রতিহত করার জন্য এবং তার লেখনীকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য সন্ত্রাসী কায়দায় প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ও বীভৎসতা দ্বারা যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান ও সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার বিষয়ে লেখেন বা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়াই ছিলো মূল উদ্দেশ্য।
আদালত আরও বলেন, জনমনে ভীতির সঞ্চার করে এবং জননিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে ভিকটিম হত্যা করে এই আসামিগণ গর্হিত অপরাধ করেছেন, যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে অনুজ্জ্বল করেছে। ফলে এই আসামিরা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে আদালতের কোনো অনুকম্পা পাওয়ার হকদার নয়। বরং এই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অন্যান্য সন্ত্রাসী জঙ্গি উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিত হবে।
পর্যবক্ষণে আদালত বলেন, অনন্তকে হত্যার পরপরই টুইটারে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এই হত্যার দায় স্বীকার করলেও বাংলা টিম বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ সত্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়নি।
মামলা থেকে শফিউর রহমান ফারাবীকে খালাস প্রদান প্রসঙ্গে আদালত বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় ফারাবী অন্য মামলায় কারাগারে ছিলেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোমিনুর রহমান টিটু বলেন, 'এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।'
বাদীপক্ষের আইনজীবী মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, 'ফারাবীকে খালাস প্রদান করায় রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা আদালতে ফারাবীর অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তবু কী কারণে তাকে খালাস প্রদান করা হলো তা বুঝছি না। আমরা এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করব।'
উচ্চ আদালতে আপিলের কথা জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুল আহাদও। তিনি বলেন, 'এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আবুল খায়েরের সামান্যতম সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। ওই সময় সে ফেসবুক বা ব্লগ ব্যবহার করত না। অনন্ত বিজয়কেও চিনত না।'
তিনি বলেন, 'এই রায়ে ন্যায়বিচার গুরুতর লঙ্ঘিত হয়েছে। আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে যাব। আমি মনে করি এই রায় যথার্থ হয়নি। আইনের পরিপন্থি রায় হয়েছে।'
রায় ঘোষণাকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন অনন্ত বিজয়ের ভগ্নিপতি সমর বিজয় শ্রী শেখর। রায় দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'রায় বাস্তবায়ন হলেই পরিবার কিছুটা স্বস্থি পাবে। এছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত তিনজনই পলাতক রয়েছে। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।'
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১২ মে সকালে নগরের সুবিদবাজারে নিজ বাসার সামনে খুন হন অনন্ত বিজয়। পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করতেন। 'যুক্তি' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি, যুক্ত ছিলেন মুক্তমনা ব্লগের সাথে। এ ছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পুলিশের অভিযোগপত্র অনুসারে, লেখালেখির কারণে উগ্রবাদী গোষ্ঠীই তাকে হত্যা করেছে।
অনন্তকে হত্যার পরদিনই তার বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ সিলেট বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এর প্রায় ৭ বছর পর আজ মামলার রায় প্রদান করা হলা।