কলাবাগানের শিশুরা কি হারাচ্ছে তেঁতুলতলা খেলার মাঠ?
তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিকের বৈঠকের পরও সেখান থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। আশ্বাস মিলেছে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে তিনি বলেছেন, তেঁতুলতলা মাঠটি কখনো খেলার মাঠ ছিল না। তার ভাষায়, আবাসিক এলাকায় ১ বিঘার মতো ওই জমিটি পরিত্যক্ত ছিল, তা এখন পুলিশের সম্পত্তি।
মাঠে থানা নির্মাণের প্রতিবাদে টানা কয়েকদিন ধরে চলা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বুধবারও ছিল। এ সময় থেমে থাকেনি নির্মাণকাজও।
এরই মধ্যে বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করেন একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল। দলে ছিলেন পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, 'নিজেরা করি'র প্রধান নির্বাহী খুশী কবির, স্থপতি ইকবাল হাবীব ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গীতা ইমাম।
বৈঠক শেষে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা কিছুটা আশা নিয়ে ফিরছি। উনার কথা শুনে বুঝেছি, উনি এটা সক্রিয় বিবেচনায় রাখবেন।'
খুশী কবির বলেন, 'আমরা স্পষ্ট করে বলেছি যে এখানে যে কাজটা (নির্মাণকাজ) হচ্ছে, তা দ্রুত বন্ধ করাতে চাই। আমরা চাচ্ছি যে এবারের ঈদের জামাত যেন ওখানেই হয়, যেটা সব সময় হয়ে আসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। বিকল্প জায়গা (থানার জন্য) খুঁজবেন। আমাদেরও বলেছেন, বিকল্প জায়গা খুঁজতে সহায়তা করতে।'
তেঁতুলতলা মাঠে চলমান নির্মাণকাজ বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দেবেন কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি নিজেও খেলার মাঠটার ব্যাপারে অনুভব করছেন। কিন্তু তারা ২৭ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আমরা বলেছি, সেটা তো সরকারি কোষাগারেই আছে। সেখানে (কলাবাগানে) আরও অনেক পরিত্যক্ত জায়গা আছে।'
দেয়াল তুলে ফেললে ঈদের জামাত হতে পারবে না, বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, 'তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেয়াল নির্মাণের ব্যাপারে বলেছেন, "আমি এখনই ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছি। আর এটার বিকল্প অন্য কোনো জায়গায় যাওয়া–সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে, যেহেতু আমরা টাকা দিয়ে দিয়েছি।"
বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রতিনিধিরা জানতে চান, এখান থেকে ফিরে শিশুদের কাছে গিয়ে কী বলবেন তারা। 'উনি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বললেন, প্রধানমন্ত্রীকে জানাব বিষয়টি, বিকল্প মাঠের কথা,' বলেছেন রিজওয়ানা হাসান।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের দাবি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখবেন। সে চিঠি আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবেন।
এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যেটাকে তেঁতুলতলা মাঠ বলছেন, সেটা কখনও মাঠ ছিল না। এটা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল।"
"আমরা শুনেছি। লোকালয়ের পাশে খালি জায়গা, এখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করত। একটু আলাপচারিতার জন্য এই জায়গাটি ছিল। এখন সবাই এই জায়গা নিয়ে নানান কথাবার্তা বলছে।"
থানা ভবনের গুরুত্ব তুলে ধরে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, "ঢাকা শহরে যে নতুন নতুন থানা ভবন হচ্ছে, বেশিরভাগই ভাড়াবাড়িতে। ভাড়াবাড়িতে থাকার কারণে আমাদের পুলিশ ফোর্স নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সেজন্য এগুলোকে স্থায়ী স্থানে নেওয়ার জন্য আমরা নিয়ম অনুযায়ী ডিসির (জেলা প্রশাসক) কাছে ঢাকা শহরের কোনো জায়গায় জমি অধিগ্রহণের জন্য বলেছিলাম।"
"ঢাকার কলাবাগানের কোনো জায়গায় দেওয়া যায় কিনা বলেছিলাম। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে এই জায়গাটি বরাদ্দ দেন। সেই জায়গাটির যে মূল্য তা ঢাকা মহানগর পুলিশ জমা দেওয়ার পর ডিসি জায়গাটি হস্তান্তর করে দিয়ে যান। এটা ছিল মূলকথা।"
দু'দিন আগে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে কথা বলেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমাদের স্পষ্ট কথা, আমাদের জায়গা প্রয়োজন। কলাবাগানের একটি থানা ভবন প্রয়োজন। সেটার দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা বলছি, এই জায়গাটা আমরা পেয়েছি, এর চেয়ে যদি ভালো, সুইটেবল জায়গা ওখানকার মেয়র সাহেব কিংবা অন্য কেউ যদি ব্যবস্থা করতে পারেন, তখন আমরা সেটা কনসিডার করব। আপাতত আমাদের থানার জন্য এটাই নির্দিষ্ট জায়গা, সরকারিভাবে এটা ব্যবস্থা হয়েছে।"
তাহলে সেখানে নির্মাণ কাজ চলবে- প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "নির্মাণকাজ হবে কি হবে না, সেটা পরের কথা। জায়গাটি পুলিশের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাদ্দ যেহেতু হয়েছে সেই জায়গাটি পুলিশের।
"কিছুক্ষণ আগে যারা আসছিলেন, তারাও আমাদের কাছে একটা আবেদন করেছেন, বিকল্প কিছু করা যায় কিনা, সেই পর্যন্ত স্থগিত রাখার জন্য। থানাও জরুরি দরকার, বাচ্চারা যারা কথা বলছে, তাদেরও একটা রিক্রিয়েশন দরকার। সেজন্য বলছিল আপাতত কনস্ট্রাকশনটা না করে আমরাও খুঁজি দেখি, এটাই তাদের আবেদন ছিল।"
"আমি বলেছি, আমরা তো এখনই কনস্ট্রাকশনে যাচ্ছি না। খুঁজুন আমরা দেখব। আপনারা যদি এর চেয়ে ভালো অফার দিতে পারেন আমরা অবশ্যই দেখবো। এটাই বলা হয়েছে," বলেন তিনি।
মাঠ-জলাশয় রক্ষা করে উন্নয়ন কাজ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা মন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে তিনি বলেন, "এখানে মনে হয় ২০ কাঠা জমি, খুব বড় জমি কিন্তু নয়, ফুটবল খেলার মাঠ এরকমও কিছু নয়, টেনিস খেলার মাঠ হবে দুটো, সেই রকমও কিছু নয়। এটা খুবই ছোট জায়গা। এটা আপনারা নিজেরাও বোঝেন।"
"চিকন-লম্বালম্বি জায়গা, জায়গাটি সুন্দর কিংবা ভালো অবস্থায় সেই রকমও কিন্তু নয়। তারা যেহেতু একটা আবেদন করে গিয়েছে আমরা দেখব। আমরা যদি এর চেয়ে সুইটেবল কিছু পাই, যেহেতু আমরা টাকা দিয়ে ফেলছি, সেটার কী হবে? সবকিছু আমরা আলোচনা করব।"
সীমানা প্রাচীর নির্মাণ স্থগিত রাখার জন্য ডিএমপি কমিশনারকে বলবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি এবারও সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বলেন, "আমি বলেছি, আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করব।"
কলাবাগান আবাসিক এলাকায় (পান্থপথের দক্ষিণ পাশে) তেঁতুলতলায় শিশু-কিশোররা যেমন খেলত, তেমনি নানা সামাজিক অনুষ্ঠানও চলে আসছিল। স্থানীয়রা একে তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবেই চেনে।
মাঠটি পুলিশ কলাবাগান থানা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ নিলে তার প্রতিবাদে নামে ওই এলাকার বাসিন্দারা, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন উদীচীর কর্মী সৈয়দা রত্না।
গত রোববার পুলিশ ওই মাঠে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করলে রত্না সেখানে গিয়ে ফেসবুক লাইভ শুরু করলে তাকে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়; পরে তার কিশোর ছেলেকেও থানায় আনা হয়য়। অনলাইনে-অফলাইনে তুমুল ক্ষোভ ও বিক্ষোভের মধ্যে ১৩ ঘণ্টা পর মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
সিদ্ধান্ত থেকে না সরলে আন্দোলনের হুমকি
এদিকে থানা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মাঠ শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়া না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী, পরিবেশকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও স্থানীয়রা। বুধবার তেঁতুলতলা মাঠে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে এসব কথা বলেন তারা। এসময় মাঠের সীমানা ঘেঁষে ১৪টি দেশীয় গাছ রোপণ করেন তারা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, "আপনারা যেখানে-সেখানে যখন খুশি মাঠ নিয়ে নিবেন, পুলিশ যদি এটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন তাহলে আর মাঠ থাকবে না। বলা হচ্ছে, এখানে যারা খেলতো তারা তো কলাবাগান মাঠে গিয়ে খেলতে পারবে। কিন্তু কলাবাগান মাঠে তো সবসময় সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাহলে এ এলাকার নতুন প্রজন্ম কোথায় যাবে?"
তিনি বলেন, "তারা বলেছে ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে, কিন্তু রাজউক জানে না। তাহলে কীভাবে এখানে থানা ভবন নির্মাণ হয়?"
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, "এতোকিছুর পরেও আমরা লক্ষ্য করছি এখানে দেয়াল তৈরি হচ্ছে, এর মাধ্যমে তারা একধরনের অপকৌশল নিচ্ছে। দেয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে মাঠ ব্যবহার সীমিত হয়ে যাবে।"
তিনি আরো বলেন, "আমরা একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছি। আপনারা যদি সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ করেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি আমরা এমন আন্দোলন তৈরি করবো যাতে এটি খেলার মাঠ হিসেবেই উন্মুক্ত থাকে, স্থানীয় জনগণ যাতে এটি ব্যবহার করতে পারে।"