চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কারখানা নেওয়ার পথেই লুট হচ্ছে কোটি টাকার স্ক্র্যাপ
ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানির পর সীতাকুণ্ড এলাকার কারখানায় নেওয়ার পথে নিয়মিত লুট হওয়ায় বিপাকে পড়ছে শিল্প গ্রুপগুলো।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরফলে বছরে প্রায় ২৫ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদার হাট থেতে সীতাকুন্ড উপজেলা সদরের ১২ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে দেশের বড় বড় ইস্পাত কারখানা গুলো। এর মধ্যে রয়েছে বিএসআরএম, কেএসআরএম, একেএস স্টিল, জিপিএইচ ইস্পাত, এসএআরএম, আরএসআরএম এর মত প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে নগরীর নাছিরাবাদে বিএসআরএম এর বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে।
বন্দর থেকে খালাস করে এসব কারখানায় স্ক্র্যাপ নেওয়ার পথে লুট ও চুরির ঘটনা ঘটছে । স্ক্র্যাপ লুটপাটকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি, এমনকি বাধা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলায় শ্রমিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বন্দর থেকে স্ক্র্যাপ বোঝাই ডাম্পার ট্রাক কারখানায় যাওয়ার পথে নগরীর সিটি গেট এলাকায় গাড়িতে হামলা চালায় সংঘবদ্ধ লুটেরা চক্র। এসময় তাদের হামলায় গাড়িতে থাকা আবুল হাসেম নিরব (১৯) নামে এক পাহারাদারকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ি, স্ক্র্যাপ লুটের ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ, হালিশহর, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং এবং সীতাকুণ্ড থানায় অর্ধ-ডজন মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছেন ৩০ জনের বেশি। কিন্তু এরপরও থামছেনা স্ক্র্যাপ লুট।
দেশে ইস্পাত শিল্পের সব চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম কর্তৃপক্ষের হিসেবে অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৯টি জাহাজে প্রতিষ্ঠানটি ২ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে কারখানায় নেওয়ার পথে লুট হয়েছে প্রায় ৯১৭ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ। লুট হওয়া স্ক্র্যাপের বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দিন দিন চুরির ঘটনা বাড়ছে। এটি আমাদের শিল্পের জন্য এখন বড় ধরনের হুমকি। আমরা নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু এরপরও থামছে না।"
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সীতাকুন্ডের দুরত্ব পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এই পথের ৩০টি স্পটে এসব লুটের ঘটনা ঘটছে।
সবচেয়ে বেশি লুটের ঘটনা ঘটে বন্দর থানাধীন পোর্ট লিংক রোডের টোল প্লাজা থেকে আকবর শাহ থানার শুকতারা মোড় এলাকা পর্যন্ত এই অংশে। এই অংশে কয়েকদিন পরপরই স্ক্র্যাপ লুটের ঘটনা ঘটছে।
চালকের যোগসাজশে স্ক্র্যাপ চুরি
ইস্পাত কারখানা গুলোর নিজস্ব তদন্তে উঠে এসেছে, স্ক্র্যাপ চুরির এসব ঘটনার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালকের যোগসাজশ রয়েছে।
চোরাই চক্রের সাথে জড়িত চালকরা স্ক্র্যাপ পরিবহনের সময় সুযোগ বুঝে লরি বা ড্রামট্রাক রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে দেয়। অন্য আরেক চালক এসে গাড়িকে পাশের গোডাউনে নিয়ে সিল ভেঙে স্ক্র্যাপ নামিয়ে নেয়। পুরো ঘটনা ধামাচাপা দিতে লাগিয়ে দেওয়া হয় একই ধরনের নকল সিল। এরপর কর্তৃপক্ষ কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়ির চালক কারখানায় মালামাল আনলোড করে চলে যান।
জিপিএস ইস্পাতের তথ্যমতে, ২০২১ সালে প্রায় ২৮ কোটি টাকার বেশি মূল্যের স্ক্র্যাপ খোয়া গেছে প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়াও কেএসআরএম, একেএস স্টিলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও বছরে গড়ে ৪-৫ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুলদ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্ক্র্যাপ চুরিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে এক শ্রেণির মানুষ। দিন দিন চুরি হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। আমরা খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে। যদি সমন্বিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায় তবে আরো কার্যকর হবে।"
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দায়েরকৃত মামলাগুলো নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।"
"চুরি হওয়া স্ক্র্যাপ যারা ক্রয় করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সারা দিনই স্ক্র্যাপ বহনকারী ট্রাকগুলো চলাচল করে। বিক্ষিপ্তভাবে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলেছি, তারা যদি একসঙ্গে ১০-১৫টি ট্রাক নিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আমরা এস্কট দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়া আমাদের ডিবি, দক্ষিণ ও পশ্চিম বিভাগ আলাদা করে কাজ করছে এ বিষয়ে। একটি নিরাপত্তা রুটও তৈরি করা হচ্ছে", বলেন তিনি।