গতিপথ বদলাচ্ছে কর্ণফুলী
দেড় যুগ আগে কর্ণফুলী নদীতে পিলার সেতুর পরিবর্তে ঝুলন্ত সেতুর দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। তার শঙ্কাই এখন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে চাটগাঁবাসীর সামনে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শাহ আমানত সেতুর পিলারের কারণে গত এক যুগে অস্বাভাবিকভাবে বদলে গেছে দেশের লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীর গতিপথ। সেতুর উত্তর অংশের ১ ও ২ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় নদীর বর্তমান গভীরতা মাত্র ৭.৭ ফুট।
স্বাভাবিক অবস্থায় সেখানে গভীরতা ২৫ ফুট থাকার কথা। অন্যদিকে, সেতুর দক্ষিণ অংশের ৪ ও ৫ নম্বর পিলারে নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট। কিন্তু সেখানে সৃষ্টি হয়েছে ৭৮.৬ ফুট গভীর খাড়ি; যা স্বাভাবিকের চাইতে তিনগুণের বেশি গভীর।
চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তলদেশের বাস্তব পরিস্থিতি ও দখল নিয়ে এ গবেষণা জরিপ পরিচালনা করা হয়। 'কর্ণফুলী নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন' নামে এক সংগঠনের উদ্যোগে এ গবেষণা জরিপ পরিচিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীর স্বাভাবিক স্রোত শাহ আমানত সেতুর উত্তর অংশের পিলারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সে তীরে পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে, উত্তরে বাধা পেয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে তৈরী হয়েছে অস্বাভাবিক স্রোত; এ কারণে নদীর তলদেশ অস্বাভাবিকভাবে ঢালু হয়ে গেছে।
আরও বলা হয়, ২০০০ সালে শাহ আমানত সেতু পয়েন্টে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩০.৩১ মিটার। কিন্তু বর্তমানে উত্তর তীরে পলি জমে এ নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটার। গত ২২ বছরে বিলীন হয়ে গেছে নদীর প্রায় ৫০০ মিটার এলাকা। যেখানে বর্তমানে ফিশারিঘাট, বরফকল ও বস্তিসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
এ জরিপ কাজ পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও রোড কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন কুমার পালিত, কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী ও মেরিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নোমান আহমদ সিদ্দিকি।
ম্যানুয়াল ও ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর তলদেশে জরিপ পরিচালনা করে দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর চর পাথরঘাটার স্বাভাবিক গভীরতা ২৫ ফুট, মাঝনদীতে যা ৩৮ ফুট এবং উত্তর পাশে ফিরিঙ্গি বাজার ব্রিজঘাট এলাকায় ২৪ ফুট। এই এলাকাটিতে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়মিত ড্রেজিং কাজ চালু রাখায় নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
কিন্তু এর ঠিক ৫০০ মিটার উজানে চাক্তাই খালের মোহনায় উত্তর পাশে কর্ণফুলীর প্রকৃত সীমানা থেকে তিনশ ফুট নদীর অংশে গভীরতা মাত্র ২ ফুট, মাঝ নদী বরাবর ১৩.৬ ফুট এবং দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট।
অপরদিকে, চাক্তাই খালের মোহনা থেকে ৫০০ ফুট উজানে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝনদীতে নদীর গভীরতা মাত্র সাড়ে ৭ ফুট! কিন্তু শাহ আমানত সেতুর তিন নম্বর পিলার বরাবর নদীর গভীরতা ৬০.৯ ফুট! অর্থাৎ নদীর তলদেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সেতুর উত্তর অংশের দুটি খাল দিয়ে প্রতিনিয়ত পলি এসে সেতুর উত্তরাংশে অর্ধেকের বেশি ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে দুই নম্বর পিলারের কাছে মাত্র ৭ ফুট গভীরতা পাওয়া গেছে।"
জরিপে আরও দেখানো হয়, কর্ণফুলী সেতুর উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী ২৫ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমান গভীরতা হচ্ছে মাত্র ৭.৭ ফুট। এছাড়া ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা থাকার কথা ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার গভীরতা অনুযায়ী ৩৮ ফুট। বাস্তবে এই দুই পিলারের মধ্যখানে চর জেগেছে। আবার সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলার এলাকায় স্বাভাবিক গভীরতা ৩৮ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমান গভীরতা বেড়ে ৬৪.৭ ফুট এবং সেতুর দক্ষিণ তীরে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারে নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট। কিন্তু সেখানে গভীরতা ৭৮.৬ ফুট।
জরিপ দলের প্রধান ও মেরিন ফিসারিজ একাডেমির অধ্যাপক নোমান আহমেদ সিদ্দিকি বলেন, "সেতুর উত্তরাংশে নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থেকে ৪৭৬ মিটার ভরাট হয়ে স্রোতের স্বাভাবিক গতিপথ বদলে দক্ষিণে সরে গেছে। এতে সেতুর দক্ষিণ প্রান্তের দুটি পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে সেখানে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। নদী ড্রেজিং করে দ্রুত স্রোতের স্বাভাবিক গতিপথ ফিরিয়ে না আনলে সেতুটি সামনে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহেদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কয়েক দিন আগেও আমরা সবকিছু দেখে এসেছি। সেতুর কোনো পিলার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। সেতুর যে অংশে তারা ৭৮ ফুট গভীরতা পেয়েছেন, সেখানে পিলারের পাইলিং আছে ২৫৫ ফুট। তাই এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা যাবে না।"
বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর উপর দুটি পিলার সেতু রয়েছে। ১৯৩০ সালে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের পর নদীর মাঝপথে সৃষ্টি হয় বিশাল একটি চর- যা কুলাগাঁও চর নামে পরিচিত। আশি বছর পর ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে নির্মাণ করা হয় তৃতীয় কর্ণফুলী বা শাহ আমানত সেতু। ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। বর্তমানে শাহ আমানত সেতুটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, বান্দরবান জেলায় সড়ক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সেতু চালুর এক যুগ পার না হতেই নদীর তলদেশে তৈরী হয়েছে বিশাল চর, যা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে শাহ আমানত সেতুকেও।