দুঃখের নাম সুরমা!
সিলেটের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমা। এই নদীকে ঘিরেই বেড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের জনবসতি, কৃষি, বাণিজ্য আর যোগাযোগ। তবে এই সুরমাই এখন হয়ে ওঠেছে সিলেটের দুঃখের নাম। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য ঢলেই নদী উপচে সিলেট অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে বন্যা। গত এক মাসের ব্যবধানে দুইবার বন্যার কবলে পড়ে সিলেট।
সিলেটে ঘনঘন বন্যার জন্য সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। খননের দাবিও উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে উপেক্ষিত থেকে গেছে এ দাবি। নদী খননে এ পর্যন্ত ৪টি প্রকল্প নেওয়া হলেও একটিও আলোর মুখ দেখেনি। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষদের।
তবে গত ১৮ মে সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে এসে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবুল মোমেনও বলেন, 'সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি আটকে থাকছে। এই নদী খনন করতে হবে। সিলেটের নদীগুলো খননের ব্যাপারে আমাদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। আমরা নদী খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী বর্ষার আগেই নদীগুলো খনন করতে হবে।'
উৎসমুখই ভরাট
দীর্ঘদিন থেকে দাবি উঠলেও গত এপ্রিলে অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর ভরাট হয়ে যাওয়া সুরমা নদী খননের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে। আর সিলেটের চলমান বন্যার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও বলছেন সুরমা খননের প্রয়োজনীয়তার কথা।
প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, সুরমার উৎসমুখই ভরাট হয়ে গেছে। এ নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর।
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম বলেন, উজান থেকে ঢলের সময় পানির সাথে বালু ও পলি নামে। এতেই ভরাট হয়ে গেছে সুরমার তলদেশ। সবচেয়ে বেশি ভরাট হয়েছে নদীর উৎসমুখ।
তিনি বলেন, 'সুরমা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ঢলের পানি নদী ধারণ করতে পারছে না। নদী উপচে পানি জনবসতিতে ঢুকে পড়ে। এতে বন্যা দেখা দেয়। তাই জরুরী ভিত্তিতে সুরমা নদী খনন প্রয়োজন। তবে নিচের দিক খননের চেয়ে উজানে খনন করা বেশি জরুরি।'
কেবল উৎসমুখই নয়, ঢলের সাথে আসা বালি ও পলিতে ভরাট হয়ে গেছে প্রায় পুরো সুরমা নদী। শুষ্ক মৌসুমে জকিগঞ্জ থেকে সিলেট পর্যন্ত নদীতে শতাধিক স্থানে জেগে ওঠে চর। দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, কানাইঘাট, টুকেরবাজারসহ কয়েকটি স্থানে নদীর জেগে ওঠা চরে শুষ্ক মৌসুমে সবজি চাষও করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এসময় বন্ধ হয়ে যায় নৌ যান চলাচল।
প্রায় পুরো নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে সুনামগঞ্জের কিছু অংশ খনন করা হলেও তাতে কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
পুরো নদী খননের দাবি জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কেবল নগরের অংশ নয়, পুরো নদী খনন করতে হবে। না হলে কোন উপকার হবে না।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, 'সুরমা নদী ভরাটের কারণেই এবার নগরীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নদী খননের জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করবো।'
১০ বছরে চার প্রকল্প
২০১২ সালে সুরমা নদী খননে সর্বপ্রথম একটি প্রকল্প গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবোর সিলেট কার্যালয় থেকে এই প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। প্রস্তাবনার পর নদী খননে সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর নদী খননে উদ্যোগ নেওয়ার কথা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো। তবে এরপর এ ব্যাপারে আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এরপর ২০১৭ সালে ৩০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প প্রেরণ করে পাউবো। আর ২০১৯ সালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন, বাধ নির্মাণ ও নদী তীর প্রতিরক্ষার জন্য ২২শ কোটি টাকার একটি ডিপিপি প্রেরণ করে পাউবো। সেবারও সমীক্ষা চালানো হয়। তবে এবারও সমীক্ষাতেই আটকে যায় কার্যক্রম।
এরপর ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সুরমা খননে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। ওইবছর তারা সমীক্ষাও চালায়। তবে এই প্রকল্পও এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, নদী খননে আমরা তিনটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকল্পগুলো পাস হয়নি।
তিনি বলেন, সমীক্ষা করার পর বিআইডব্লিউটিএ থেকে আমাদের জানানো হয়, আমাদের ডিপিপি থেকে খননের বিষয়টি বাদ দেয়ার জন্য। এরপর তারা ড্রেজিংয়ের জন্য আলাদা একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। তারাই সুরমা ও কুশিয়ারা খনন করবে।
আসিফ আহমদ বলেন, পরে ২০২১ সালে আমরা নদী খননের বিষয়টি বাদ দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা তীরে বাঁধ ও ডাইক নির্মাণ এবং নদী তীর প্রতিরক্ষায় ৪ হাজার কোটি টাকার আরেকটি ডিপিপি প্রেরণ করেছি। এটিও এখন সমীক্ষার পর্যায়ে আছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) মো. ছাইদুর রহমান বলেন, আমরা ৩ হাজারের কিছু বেশি টাকার একটা প্রকল্প জমা দিয়েছিলাম। অনেকদিন আগেই এটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা হয়েছিলো। তবে এখনো পাস হয়নি।
তবে পাউবোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুরমা ও কুশিয়ারা ভারত থেকে উৎপত্তি হয়েছে। সুরমার প্রথম ২৫ কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত লাইন দিয়ে গেছে। ফলে উৎসমুখ থেকে খননের জন্য যৌথ নদী কমিশন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
যৌথ নদী খনন করতে হলে দুই দেশের যৌথ সম্মতি ও চুক্তির প্রয়োজন হয়। ভারতের সাথে চুক্তি না হওয়ায় এতোদিন আটকে ছিলো এ নদী খনন। তবে সম্প্রতি যৌথ নদী প্রটেকশনের আওতায় ভারতের সাথে চুক্তি হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বর্তমানে যুক্তরাজ্য সফরে থাকায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে গত ২ মে নিজ নির্বাচনী এলাকার বন্যায় ফসলহানি পরিদর্শনে এসে তিনি বলেন, অকাল বন্যা ও ঢল মোকাবেলায় আগামীতে এই অঞ্চলের নদনদী খনন করা হবে।