ডিপোর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকও ডিপো কর্তৃপক্ষ
অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে নয়, ডিপো কর্তৃপক্ষের নিজেদের উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ডিপো কর্তৃপক্ষের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে উৎপাদিত এই রাসায়নিক পদার্থ কম্বোডিয়ায় রপ্তানির জন্য ডিপোতে রাখা হয়েছিল।
ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অরক্ষিত অবস্থায় রাখার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। ডিপোর শ্রমিকরা বলছেন, এই রাসায়নিক পদার্থ কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই ডিপোতে রাখা হয়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোনো আলাদা শেডে নয়, ডিপোর কন্টেইনার ইয়ার্ডেই পড়ে ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। গত ১ ও ২ জুন হাটহাজারী ফতেয়াবাদের আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড থেকে ৮৫০ মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সীতাকুণ্ডের এই ডিপোতে আনা হয়। রপ্তানির জন্য এসব রাসায়নিক পদার্থ ৩৩ কন্টেইনার ভর্তি করে ইয়ার্ডে রাখা হয়। একটি শিপিং কোম্পানির জাহাজের শিডিউল দিতে না পারায় রপ্তানি বিলম্ব হচ্ছিল।
বিএম কন্টেইনার ডিপো অব ডকের সহকারি কমিশনার উত্তম চাকমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শিপিংয়ের শিডিউল পেতে দেরি হওয়ায় মালিক পক্ষ এসব রাসায়নিক পদার্থ কারখানায় ফেরত পাঠানো সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। তবে এসব রাসায়নিক পদার্থ ইয়ার্ডে পড়ে ছিল।"
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহতায় রূপ নেওয়া কারণ হিসেবে কনটেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে দায়ি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ভর্তি কনটেইনার লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে বলে জানায় সংস্থাটি।
তবে দুর্ঘটনার ৪৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হলেও ডিপোতে থাকা রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ সম্পর্কে জানাতে পারেনি ডিপো কর্তৃপক্ষ।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, "বিএম কনটেইনার ডিপোতে কেমিক্যাল রাখার কেনো ব্যবস্থাপনাই ছিল না। সাধারণত কোন কনটেইনারে কী আছে, তার একটা চার্ট থাকার কথা। কেমিক্যালগুলো আইসোলেটেড অবস্থায় থাকার কথা। কিন্তু এর কিছুই ছিল না ডিপোতে।"
ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিস আগ্রাবাদ শাখার ইন্সপেক্টর মাহবুব-ই-ইলাহী বলেন, "কর্তৃপক্ষ জানেনা কী কেমিক্যাল আছে সেটা কীভাবে হয়। আমরা এর আগের দুর্ঘটনায়ও দেখেছি মালিক পক্ষ তথ্য গোপন করে। এ কারণেই আমাদের ৯ সঙ্গীকে জীবন দিতে হয়েছে।"
ডিপোতে থাকা রাসায়নিক পদার্থ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদিত হয়েছে ডিপো পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের আরেকটি কারখানা আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ এলাকার ঠান্ডাছড়িতে কারখানাটি অবস্থিত। ওই কারখানায় উৎপাদিত এসব রাসায়নিক পদার্থ কম্বোডিয়ায় রপ্তানির জন্য বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাখা হয়েছিল। আর এই রাসায়নিক পদার্থ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের প্রাণ গেছে। এছাড়া দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে।
রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন এবং সংরক্ষণকারী দুটি প্রতিষ্ঠানই একই শিল্পগ্রুপের হওয়ার পরও এ সংক্রান্ত তথ্য দিতে না পারায় প্রশ্ন উঠেছে। ডিপো কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র শামসুল হায়দার সিদ্দিকী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দুটি প্রতিষ্ঠানই আমাদের। আমাদের পণ্যই রপ্তানির জন্য এখানে রাখা হয়েছিল। আমরাও চেষ্টা করছি, সকল তথ্য জানার। ডিপোতে যারা ছিলেন, তারাও আহত হয়েছেন। তাই এখনই তথ্য জানা যাচ্ছে না।"
মানবাধিকার কর্মী আমিনুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। হয়তো কোম্পানির মালিকরা দুর্ঘটনার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এটি একটি বড় কোম্পানি। তা চালানোর জন্য নিশ্চয় মানুষ রয়েছে। যাদের নখদর্পণে রয়েছে কোথায় কোন ধরনের কেমিক্যাল ছিল! বিষয়টি তারা ফায়ার সার্ভিসকে না জানিয়ে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।"
দ্য অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) তথ্যমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ ১৩.৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করে।
বাংলাদেশ এই রাসায়নিক পদার্থ রপ্তানিতে ১৭ তম অবস্থানে রয়েছে। এই রাসায়নিক পদার্থটি দেশের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি পণ্যের তালিকার ৮৯তম অবস্থানে রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করে। মূলত টেক্সটাইল, কাগজ এবং পাল্প শিল্পের ব্লিচিং এবং জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রধান রাসায়নিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এটি।
শুধু রপ্তানিতে নয়, সবচেয়ে বেশি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আমদানির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম। ২০২০ সালে দেশে ৬৫৬ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আমদানি করা হয়। মূলত থাইল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারত থেকে এই রাসায়নিক পণ্য আমদানি করা হয়।
এর আগে শনিবার (০৪ জুন) সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কন্টেইনারে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ ৪৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। ঘটনার ৪৪ ঘণ্টা পার হলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একটি বিশেষজ্ঞ দল রোববার সকাল থেকে কাজ করছে। এছাড়া ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।