আজম খান, গুরু তোমায় সালাম
বাংলাদেশে পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের অগ্রদূত আজম খান। ভালোবেসে, সম্মান করে তাকে সবাই 'পপ গুরু' নামে ডাকে। আজ তার জন্মদিন। ২০১১ সালের ৫ জুন চিরঘুমে হারিয়ে যাওয়ার আগে, ১৯৫০ সালের এ দিন তিনি পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় প্রথমবার চোখ মেলেছিলেন।
বেড়ে ওঠা
বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ও মা জোবেদা খাতুনের সংসারে, ঢাকার আজিমপুরে তার জন্ম। পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। বাবার চাকরিসূত্রে তার শৈশব কেটেছে আজিমপুরের ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে। বড় ভাই সরকারি কর্মকর্তা সাইদ খান, মেজো ভাই বিখ্যাত সুরকার আলম খান, ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী খান এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খান।
আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে আজম খানের পড়াশোনা শুরু, ১৯৫৫ সালে। পরের বছর বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানানোর পর থেকে সেখানেই কেটেছে তার জীবনের বাকি দিনগুলো। ১৯৬৮ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দেশ স্বাধীনের পর গান নিয়ে ব্যস্ততায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নিয়ে ভাবেননি আর।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হেঁটে হেঁটে ভারতের আগরতলায় চলে যান আজম খান। সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি গান গেয়ে বাকিদের প্রেরণা যোগাতেন। মেলাঘর শিবিরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে কুমিল্লায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। প্রথম যুদ্ধটি করেন কুমিল্লার সালদায়। কিছুদিন পর আবারও আগরতলায় ফিরে যান তখন মাত্র ২১ বছরের এই টগবগে তরুণ।
এরপর ফিরে আসেন ঢাকায়, গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে। অকুতোভয় এই বীর ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ। সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে, মূলত ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও গুলশান এলাকার অপারেশনগুলো পরিচালনা করেন তিনি।
'অপারেশন তিতাস' আজম খানের নেতৃত্বে হওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গেরিলা আক্রমণ। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও হোটেল পূর্বাণীসহ ঢাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেলে অবস্থিত বিদেশিদের যুদ্ধের বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তাদের। এই যুদ্ধে বাম কানে মারাত্মক আঘাত পান আজম খান। এটি তাকে পরবর্তী জীবনেও ভুগিয়েছে।
এছাড়া মাদারটেকের কাছাকাছি, ত্রিমোহনীর যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনিকে পরাজিত করেন আজম ও তার সহ-যোদ্ধারা।
গানের লড়াই
মূলত ১৯৬০-এর দশকেই গানের শুরু তার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজের 'উচ্চারণ' ব্যান্ড নিয়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে আইকনে পরিণত হন তিনি। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয় তার 'এত সুন্দর দুনিয়া কিছুই রবে না রে' ও 'চার কলেমা সাক্ষী দেবে' গান দুটি। ১৯৭৪ সালে বিটিভিতেই প্রচারিত 'বাংলাদেশ' গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। 'রেললাইনের ঐ বস্তিতে...' নামে গানটি বেশি পরিচিত।
আজমের গাওয়া আরও বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে- 'আলাল ও দুলাল', 'ওরে সালেকা, ওরে মালেকা', 'পাপড়ি কেন বোঝে না', 'অভিমানী', 'অনামিকা', 'আসি আসি বলে', 'আমি যারে চাই রে' প্রভৃতি।
ঘরের মানুষ
ব্যক্তিজীবনে তিনি সাহেদা বেগমের সঙ্গে ঘর বাঁধেন ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি। তাদের তিন সন্তান- ইমা খান, হৃদয় খান ও অরণী খান।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে, ৯ বছর আগে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও, বাংলা পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে তিনি উজ্জ্বল পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন।