মিয়া কৌতো: মোজাম্বিকের স্বাধীনতাকামীদের নজর কেড়েছিলেন যে লেখক
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেখক এবং কবি মিয়া কৌতো নিজেকে একজন আফ্রিকান হিসেবে বর্ণনা করেন, যদিও তার শিকড় ইউরোপে।
তার পর্তুগিজ বাবা-মা ১৯৫৩ সালে অ্যান্টোনিও সালাজারের স্বৈরশাসন থেকে পালিয়ে এসে বসতি স্থাপন মোজাম্বিকে করেন। তার দুই বছর পর বেইরা শহরে কৌতোর জন্ম হয়।
"আমার শৈশব খুবই আনন্দময় ছিল," তিনি বিবিসিকে বলেন। কিন্তু তিনি উল্লেখ করেন, তিনি "ঔপনিবেশিক সমাজে" বাস করছেন এবং এই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন কারণ তিনি যেখানে বাস করতেন সেখানে সাদা-কালো ও ধনী-গরিবের মধ্যকার সীমারেখাগুলি খুবই দৃশ্যমান ছিল।
শৈশবে কৌতো খুবই লাজুক স্বাভাবের ছিলেন, জনসমক্ষে বা এমনকি ঘরে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতেন না। তার বাবা, যিনি একজন কবি এবং সাংবাদিক ছিলেন, তার মতোই কৌতো লেখার মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পান।
কৌতো বলেন, "আমি কাগজের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করেছিলাম। আর সেই কাগজের পেছনে সবসময় এমন কেউ ছিল, যাকে আমি ভালোবাসতাম, যে আমাকে শুনেছিল এবং বলেছিল, 'তুমি আছো।'"
ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় কৌতো মোজাম্বিকে পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা "অ্যাসিমিলাডোস" নামে পরিচিত কালো অভিজাতদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারতেন। অ্যাসিমিলাডোসরা সেই সময়ের বর্ণবাদী ভাষায় "পর্যাপ্ত সভ্য" বলে বিবেচিত হতেন এবং পর্তুগিজ নাগরিকত্ব পেতেন।
লেখক নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন কারণ তিনি অ্যাসিমিলাডোসের শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছেন এবং তাদের কিছু ভাষা শিখেছেন। তিনি বলেন, এটি তাকে কালো সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
তিনি বলেন, "আমি শুধু তখনই মনে করি আমি একজন সাদা মানুষ, যখন আমি মোজাম্বিকের বাইরে থাকি। মোজাম্বিকের ভেতরে এটি এমন কিছু যা আমি অনুভব করতে পারি না।"
তবে ছোটবেলায় তিনি বুঝতে পারতেন, তার গায়ের রং তাকে আলাদা করেছে।
কৌতো বলেন, "কেউ আমাকে এই অন্যায় সম্পর্কে শেখায়নি… যে অন্যায় সমাজ আমি বাস করছিলাম, সেটি সম্পর্কে শেখায়নি। এবং আমি ভাবতাম, 'আমি আমার মতো হতে পারছি না। আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই না করে একজন সুখী মানুষ হতে পারবো না।'"
তার যখন ১০ বছর বয়স তখন মোজাম্বিকে পর্তুগিজ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়। ১৭ বছর বয়সে তিনি একটি ঔপনিবেশিক বিরোধী প্রকাশনার জন্য কবিতা লিখছিলেন এবং মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন, তখন তাকে বিপ্লবী আন্দোলন ফ্রেলিমোর নেতাদের সামনে হাজির হতে বলা হয়।
ফ্রেলিমোর অফিসে পৌঁছে তিনি দেখতে পান, ৩০ জনের ভিড়ে তিনি একমাত্র শেতাঙ্গ। নেতারা সবাইকে তাদের কষ্টের গল্প বলতে বলেন এবং কেন তারা ফ্রেলিমোর সাথে যোগ দিতে চান তা জানতে চান। কৌতো ছিলেন শেষ বক্তা। দরিদ্রতা এবং বঞ্চনার গল্প শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি রুমের একমাত্র সুবিধাভোগী ব্যক্তি। তাই তিনি নিজের সম্পর্কে একটি গল্প বানান, অন্যথায় তার নির্বাচিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
তিনি বলেন, "কিন্তু যখন আমার পালা এল, আমি কথা বলতে পারলাম না এবং অনুভূতির চাপে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।"
তবে ফ্রেলিমোর নেতারা ইতোমধ্যে তার কবিতা আবিষ্কার করেছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে সাহায্য করতে পারেন।
কৌতো স্মরণ করে বলেন, "যে ব্যক্তি মিটিংগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি কি সেই তরুণ যিনি সংবাদপত্রে কবিতা লিখছেন?' আমি বললাম, 'হ্যাঁ, আমি সেই লেখক'। এবং তিনি বললেন, 'ঠিক আছে, আপনি আসতে পারেন এবং আপনি আমাদের অংশ হতে পারেন কারণ আমাদের কবিতার প্রয়োজন।'"
মোজাম্বিক ১৯৭৫ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে কৌতো স্থানীয় গণমাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন এবং ১৯৮৬ সালে মোজাম্বিকের প্রথম প্রেসিডেন্ট সামোরা মাচেলের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন। এরপর তিনি ফ্রেলিমো থেকে হতাশ হয়ে পদত্যাগ করেন।
তিনি বলেন, "এক ধরনের বিভাজন ছিল; স্বাধীনতাকামীদের বয়ান এমন কিছু হয়ে উঠেছিল যা আমি আর বিশ্বাস করছিলাম না।"
ফ্রেলিমো থেকে সদস্যপদ ত্যাগ করার পর কৌতো জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি বর্তমানে সমুদ্রতটীয় এলাকাগুলোর ওপর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন এবং আবার লেখালেখিতে ফিরে এসেছেন।
তিনি বলেন, "আমি প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তারপর বই, ছোট গল্প, এবং উপন্যাস।"
তার প্রথম উপন্যাস "স্লিপওয়াকিং ল্যান্ড" ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একটি জাদুবাস্তবতা নির্ভর কাল্পনিক উপন্যাস ছিল যেটি মোজাম্বিকের স্বাধীনতা পরবর্তী গৃহযুদ্ধ থেকে অনুপ্রাণিত। বইটি ১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত চলা তীব্র সংঘাতকে তুলে ধরে, যখন রেনামো [দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা-সংখ্যালঘু শাসন এবং পশ্চিমা শক্তির সমর্থিত বিদ্রোহী আন্দোলন] ফ্রেলিমোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
বইটি তাৎক্ষণিক সাফল্য পায়। ২০০১ সালে এটি জিম্বাবুয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলায় ২০ শতকের সেরা ১২ আফ্রিকান বইয়ের একটি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি ৩৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
কৌতো তার আরও বেশ কিছু উপন্যাস এবং ছোট গল্পে যুদ্ধ ও ঔপনিবেশিকতা, মোজাম্বিকের মানুষের কষ্ট এবং তাদের কঠিন সময়ের দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করেছেন। তার বইয়ের অন্যান্য বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে: জাদুবিদ্যা, ধর্ম এবং লোককাহিনির ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক বর্ণনা।
আঙ্গোলা, কেপ ভার্দে, আফ্রিকার সাও তোমে, ব্রাজিল ও পর্তুগালের মতো পর্তুগিজ ভাষার প্রচলন আছে এমন দেশে কৌতোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
২০১৩ সালে তিনি ১ লাখ ইউরোর কামোঁইশ পুরস্কার জিতেন, যা পর্তুগিজ ভাষার লেখকদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
২০১৪ সালে তিনি ৫০ হাজার ডলারের নিউস্টাডট পুরস্কার পান, যা নোবেল পুরস্কারের পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত।
কৌতোকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তার কাজগুলো আধুনিক দিনের আফ্রিকার বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে কিনা; তখন তিনি জানান, এটি সম্ভব নয় কারণ আফ্রিকা বিভক্ত এবং অনেকগুলো ভিন্ন আফ্রিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, "আমরা একে অপরকে জানি না এবং ফরাসি, ইংরেজি এবং পর্তুগিজের মতো ঔপনিবেশিক ভাষার সীমারেখার কারণে আমাদের নিজস্ব লেখকদের লেখা প্রকাশ করি না।"
তিনি বলেন, "আমরা একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোকে উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছি যা এখন 'প্রাকৃতিকভাবে' গৃহীত হয়েছে, যেমন ইংরেজি ভাষাভাষী, ফরাসি ভাষাভাষী এবং পর্তুগিজ ভাষাভাষী আফ্রিকান।"
কৌতোর গত মাসে কেনিয়ায় একটি সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে তিনি সফরটি বাতিল করতে বাধ্য হন। তিনি আশা করেন, আফ্রিকার অন্যান্য অংশের লেখকদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য ভবিষ্যতে আরও সুযোগ আসবে।
তিনি বলেন, "আমাদের এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে হবে। আফ্রিকান হিসেবে অন্যান্য আফ্রিকানদের সাথে আমাদের সাক্ষাতের বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।"
তিনি আফ্রিকান লেখকদের আফ্রিকার নিজস্ব বৈচিত্র্য এবং তাদের দেবতা ও পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পর্ক উদযাপন করতে লজ্জা বোধ করার ব্যাপারে এবং ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নজর দেওয়ার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।
কৌতো বলেন, "আসলে, আমরা মোজাম্বিকের বাইরে শিল্প ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কী হচ্ছে তা জানি না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, তানজানিয়া সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। এবং তারা মোজাম্বিকের সম্পর্কে কিছুই জানে না।"
তরুণ লেখকদের প্রতি পরামর্শ কি হবে জানতে চাইলে তিনি অন্যদের আলাপ শোনার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "যদি একটি বইয়ের চরিত্র আপনাকে স্পর্শ করে তাহলে বুঝতে হবে, সেই চরিত্র আপনার মধ্যে আগে থেকেই ছিল এবং আপনি সেটা জানতেন না।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়