বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে অসীম সাহসের পরিচয় দেন সোলায়মান
চট্টগ্রামের সন্তান মোহাম্মদ সোলায়মান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের আহবানে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে মোহাম্মদ সোলায়মানের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় পৌঁছান। বড় ভাই আজাদসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যোগ দেন সোলায়মান। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হন দুই ভাই। ১৪৪ ধারা ভেঙে অংশ নেন মিছিলে। পুলিশের লাঠিচার্জে গুরুতর আহত হন দুই ভাই আজাদ ও সোলায়মান। মোহাম্মদ সোলায়মানের অবস্থা ছিল গুরুতর।
এদিকে চট্টগ্রামে গ্রামের বাড়িতে খবর আসে আজাদ ও সোলায়মান আর নেই, তারা আমতলার সমাবেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এ খবরে শোকের মাতম নেমেছিল চন্দনাইশ থানার উত্তর হাসিমপুর গ্রামে। তবে ২৫ ফেব্রুয়ারি সোলায়মান ও আবুল কালাম আজাদ ফিরেন মা রশিদা খাতুনের বুকে। তাদের বেঁচে ফেরার খবরে স্বস্তি ফিরে আসে গ্রামে।
মোহাম্মদ সোলায়মান ১৯২৭ সালের ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমার চন্দনাইশ থানার উত্তর হাসিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল আজিজ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। সোলায়মান ছিলেন পাঁচ ভাই-তিনবোনের মধ্যে পঞ্চম। তিনি ১৯৪৬ সালে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট।
সে সময় মোহাম্মদ সোলায়মান ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের আহবানে যুক্ত হন তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে।
ভাষা সৈনিক এ কে এম এমদাদুল ইসলাম 'ভাষা-আন্দোলন ও চট্টগ্রাম' প্রবন্ধে লিখেছেন, "তমদ্দুন মজলিশের সৈনিক নামে একটি পত্রিকা ছিল। এ পত্রিকার মাধ্যমে তাদের চিন্তাধারা প্রকাশিত হতো। তখন তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন জনাব আজিজুর রহমান, সাহাবুদ্দিন খালেদ, মাহফুজুল হক, এজহারুল হক ও মোহাম্মদ সোলায়মান।"
১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ এবং '৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় ভাষা সংগ্রামে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মোহাম্মদ সোলায়মান।
১৯৫২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আবারও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ধারাবাহিক কর্মসূচি হাতে নেয়। কর্মসূচিতে অংশ নিতে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের আহবানে ১৯ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ সোলায়মানের বড় ভাই ও তমদ্দুন মজলিস নেতা আবুল কালাম আজাদ ঢাকায় পৌঁছান। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে এক মাসের ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ৯৪, নবাবপুরে আওয়ামী মুসলীম লীগের অফিসে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মোহাম্মদ সোলায়মানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ভাঙ্গার পক্ষে মত দেন।
৪৩/১, যোগীনগরে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাজের সভায় ১৪৪ ভাঙার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানান দুই ভাই আজাদ ও সোলায়মান। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় সভা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোলায়মান ও আজাদ শিক্ষার্থীদের সাথে আমতলায় সমবেত হন। এসময় তারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সমর্থনে লেখা পোস্টার বিলি করেন। ছাত্রছাত্রীরা '১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে', 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান দিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হয়। এসময় ১৪৪ ধারা ভেঙে শুরু হওয়া মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের লাঠিচার্জে অন্যান্যদের সাথে গুরুতর আহত হন দুই ভাই আজাদ ও সোলায়মান। সোলায়মানের অবস্থা ছিল গুরুতর। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ফিরে ভাষা সংগ্রাম আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
মোহাম্মদ সোলায়মান ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম নগরের এমইএস কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। পরে আবারও কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে ফিরে গিয়ে ১৯৭৬ থেকে ৮৯ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে অবসরের পর সীতাকুন্ড কলেজে স্বল্প সময়ের জন্য অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতাকালে তিনি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তার লেখা 'আমাদের অতীত' বইটি ষাটের দশকে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই ছিল। এছাড়াও 'প্রসঙ্গ সংস্কৃতি' এবং 'পরাশক্তি ও আফগানিস্তান' নামে দুটি বই রচনা করেন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান।
১৯৯২ সালের ১৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
- টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ প্রযোজনা