আফগানিস্তানে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের পরও শূন্য হাতে ফিরেছে ভারত
আফগানিস্তানের অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল অন্ধকূপে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করে একপ্রকার বাজিই ধরে ভারত। দেশটির ওপর প্রত্যক্ষ ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এ উদ্যোগ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও বিশ্লেষণের মিলিত প্রভাবে ব্যর্থ হয়।
দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে রাতারাতি বদলে যাবে, তা হয়তো নয়াদিল্লি অনুমানও করতে পারেনি। তালেবানের ঝড়ো গতিতে ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি শক্তিগুলো আফগানিস্তানেরে মাটি থেকে দ্রুত গতিতে তাদের সেনা, বেসামরিক নাগরিক ও সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া শুরু করে; যা শুধু পাততাড়ি গুটিয়ে পালানোর সঙ্গেই তুলনীয়।
এ বাস্তবতায় গত দুই দশকের পরিক্রমায় আফগানিস্তানে নয়াদিল্লির কৌশলগত লক্ষ্য ও অর্জন কী ছিল- সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।
গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল ২০১৫ সাল। সে বছর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আফগান পার্লামেন্ট উদ্বোধন করেন। আফগান গণতন্ত্রের প্রতি উপহারস্বরূপ প্রায় ৯ কোটি ডলার ব্যয়ে এ ভবনটি নির্মাণ করে দেয় ভারত।
পরের বছর ১৯ শতকে নির্মিত ও পুনঃসংস্কার করা কাবুলের স্তোর প্রাসাদ উদ্বোধন করেন মোদি। ১৯২০ এর দশকে আফগান রাজা আমির আমানুল্লাহ খানের বাসভবন ছিল এ প্রাসাদ। ২০১৬ সালে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হেরাতে সালমা ড্যাম উদ্বোধন করেন মোদি। এই বাঁধটি আশেপাশের জেলাসমূহে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করে, চাষের আওতায় আসে হাজারো হেক্টর জমি।
একইসঙ্গে, মহাসড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণে সর্বমোট প্রায় ৩০০ কোটি ডলার লগ্নী করে ভারত। এ বিনিয়োগ ভারতকে দেশটির বৃহৎ আঞ্চলিক দাতাদের মধ্যে অন্যতম করে তুলেছিল।
চলতি মাসে ভারত সরকার নিজ দেশে অবকাঠামো নির্মাণে যে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের সুবিশাল অঙ্ক ঘোষণা করেছে, অথবা রুগ্ন ব্যাংকিং খাতকে করদাতাদের অর্থে পুনরুজ্জীবিত করতে যে হাজার হাজার কোটি ডলার খেসারত দিচ্ছে- আফগানিস্তানে করা বিনিয়োগ হয়তো তার তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু, তারপরও যখন পার্লামেন্ট ভবন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার চিত্র ভাইরাল আকারে ছড়িয়ে পরে, তখন সঙ্গত কারণেই ভারতীয় নীতিগত অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সেই পটভূমির ব্যাখ্যা জানতে চলুন নজর দেওয়া যাক মোদি সরকারের 'প্রতিবেশী প্রথম' পররাষ্ট্র নীতিতে। আনুষ্ঠানিকভাবে যার মূল লক্ষ্য বলা হচ্ছে, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপনের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা।
এজন্য নেপাল থেকে শুরু করে ভুটান পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে শত শত কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের অন্যান্য বিভাগের বাজেট থেকে। ২০১৭ সালে কাবুলে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভি. পি. হারান বলেন, 'আফগানিস্তানে এ ধরনের সহায়তার মূল উদ্দেশ্য হলো- 'দেশটি যেন পাকিস্তান সমর্থিত তালেবান গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে না যায়।'
তাই বন্ধুত্ব আর সদিচ্ছার আড়ালে নয়াদিল্লি ভালো করেই জানতো স্বার্থের প্রতি এ হুমকি সম্পর্কে। জানা ছিল, বড় বাজির দানে হেরে যাওয়ার চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
সেই ভয় এখন রূঢ় বাস্তবতার মূর্তি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এনিয়ে ভারতকে আগামী দিনগুলোকে যুঝতে হবে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসন কাশ্মীরে তিন দশক আগের বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে কিনা- ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা মহলকে এখন তার বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করার পর ওই সময় ভারত অধিকৃত এ ভূখণ্ডটির দিকে শক্তি নিবেশ করেছিল ইসলামি জঙ্গিরা।
তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, আজ যেমন যুক্তরাষ্ট্র। তাই কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবানল নতুন করে ছড়ানোর হুমকিকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
তাছাড়া, পশ্চিমা সমর্থিত আফগান সরকারের পেছনে করা বিনিয়োগ ভারতের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেনি; কারণ সত্যিকার অর্থে ভারত তার সবচেয়ে বড় যে প্রয়োজন ছিল আফগান ভূমিতে তেমন কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হয়।
মোদি প্রশাসন মুখে যতই বলুক, আফগানিস্তানে বিনিয়োগ ছিল যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটির সহায়তার আন্তরিক প্রচেষ্টা, লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে নয়- প্রকৃতপক্ষে ছিল তার উল্টোটা। পরিবর্তিত বাস্তবতায় নৈরাজ্যের অন্ধকারে নিক্ষেপিত হয়েছে আফগানিস্তান। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া জুড়ে ভারতীয় স্বার্থে দেশটি নিরাপত্তা ঝুঁকির কেন্দ্র হয়ে উঠবে না- এমনটা নিশ্চিত করার আর কোন উপায়ও থাকলো না ভারতের কাছে।
গত বৃহস্পতিবার ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর আবারো বলেছেন, ভারতের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আফগান জনতার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং পূর্ব বিনিয়োগের সম্পূর্ণ সুফলই মিলবে! 'তবে বর্তমানে অপেক্ষা করে পরিস্থিতির দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখার নীতি নিয়েছে ভারত।'
কিন্তু, তাঁর এ দাবির বিপরীতে বলা যায়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশে যদি প্রকৃত প্রভাব প্রতিষ্ঠাই ভারতের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে সে প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের বাইরে আফগানিস্তানে তাৎপর্যপূর্ণ কোন প্রকল্প বাস্তবায়িত করে লাভবান হতে পারেনি নয়াদিল্লি। যেমন; ব্যর্থ হয়েছে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে ১১শ' কোটি ডলার বিনিয়োগ করে হাজিগাক লৌহখনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। আফগান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুসুলভ সম্পর্ক থেকেও লাভ হয়নি।
ভারতের আরেকটি বড় প্রকল্প হলো, ইরানের চবাহার বন্দর নির্মাণে অংশগ্রহণ। এর মাধ্যমে আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়াকে ভারতীয় অর্থনৈতিক প্রভাব বলয়ে যুক্ত করে পাকিস্তানকে টেক্কা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু, ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার হুমকি ও কোভিড-১৯ মহামারির তীব্রতায় ইতোমধ্যেই অনিশ্চিত এ বন্দর পরিচালনার ভবিষ্যৎ; তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর যা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।
এক্ষেত্রে চীন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা যেতে পারে। এশিয়া, আফ্রিকা পূর্ব ইউরোপসহ ভারতের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অধীনে প্রকল্পগুলো বেইজিংয়ের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে ও হচ্ছে। আফগানিস্তানে অনেক কম বিনিয়োগ করার পরও চীনা কোম্পানিগুলো দেশটিতে পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের আমলেই কিছু খনি পরিচালনার সত্ত্ব পায়। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে এসব খনি পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকার পরও, আগামীদিনে লাভের হিসাব কষে উদ্যমী বেইজিংকে পিছুটান দিতে হয়নি।
চীনা সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি ছিল আগে থেকেই তালেবানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা। আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলের সাম্প্রতিক ঘটনায় চীন কীভাবে লাভবান হবে, কতোটা অর্জন করবে- বিশ্ব এখন সেই হিসাবে ব্যস্ত। আর একইসঙ্গে বলছে, ভারতের সামনে আসন্ন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিকূলতার পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে।
- লেখক: অঞ্জনি ত্রিবেদী ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট। তিনি এশিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে লেখেন। ইতঃপূর্বে, তিনি প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে যুক্ত ছিলেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত