মানসিক স্বাস্থ্যে সৌন্দর্যের প্রভাব
আমরা নিরন্তর এমন সব ছবি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট প্রকাশ করি, যেগুলো থেকে লোকেরা ভাবে, তাদেরও এমন 'পরিপূর্ণতা' অর্জন করা উচিত, অথচ সেই সাধ্য নেই। নিজের ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্যের লড়াই এবং সে সময় কতটা 'হীনমন্যতায়' ভুগেছি- তা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছি আমি।
আমজনতার চোখের সামনে বেড়ে ওঠার চাপ প্রচুর। আপনার জীবন ও পছন্দের সব দিক নিয়ে লোকে কথা বলছে এবং আপনার বিচার করছে- এমন এক দুনিয়ায় অল্প বয়সে সেই চাপ সামলানো কঠিন খুব। মাঝে মধ্যে ভাবি, এ কারণেই আমার চামড়া একটু মোটা হয়ে গেছে! আর, এভাবে বেড়ে ওঠায় আমার কোনো অনুশোচনা নেই।
এক কথায় বললে, একটা পার্থক্য তৈরি করতে সক্ষম- এমন এক প্লাটফর্ম পেয়েছি বলে নিজেকে ভীষণ রকমের সৌভাগ্যবতী মনে হয়।
তার মানে এই নয়, আমাকে কোনো কঠিন সময় কাটাতে হয়নি। তবে, নিজেকে উদার রেখেই সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর এ কারণে যারা নিজ নিজ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লড়াইরত, বছরের পর বছর ধরে এ রকম অনেকের কাছে সেই গল্প শুনেছি আমি।
এই ইস্যু আমার অন্তরের একদম নিকটবর্তী হয়ে উঠেছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপচারিতার 'কলঙ্ক'কে কমাতে সাহায্য করতে এবং নিজেদের অনন্যতা উদযাপনে মানুষকে উৎসাহ জোগাতে নিজ কণ্ঠ ব্যবহারের চেষ্টা আমি করি।
নয় একা
আমাদের সমাজে নারীর জন্য প্রচুর অবাস্তব প্রত্যাশা ছড়িয়ে রয়েছে এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড একটি সুনির্দিষ্ট তরিকায় পরিচালনা করার রয়েছে চাপ। 'পরিপূর্ণ' হওয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণার ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই রয়েছে। আমরা বৈধতা ও স্বস্তির জন্য অহর্নিশ এইসব প্লাটফর্মের ওপর ভরসা করি। অথচ শেষ পর্যন্ত এটিও আমাদের মনে খানিকটা একাকিত্বের অনুভূতি এনে দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যু নিয়ে যারা লড়াই করছেন কিংবা যারা স্রেফ কাটাচ্ছেন খারাপ সময়, তাদের সবাইকে বলতে চাই, আপনি একা নন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের 'ডিটক্সে'র ব্যাপারে আমি আসলে একজন বড় পরামর্শক! আমি এখনো এতে সংযুক্ত এবং হচ্ছেটা কী- তা দেখতে আগ্রহী; তবে 'স্ক্রলিং' করার জন্য সময় বের করা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করার চেষ্টা করি, সবাই সাধারণত দেখানোর মতো ভিডিও ও নিজেদের সেরা ছবিগুলোই শেয়ার করেন; তবে এগুলো একইভাবে না দেখার ব্যাপারে আমার মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না।
থেরাপির ব্যাপারেও আমি এক প্রবল পরামর্শক! কেন কোনো জিনিস কোনো নির্দিষ্ট তরিকায় ভাবছি, এটি আমাকে সে সম্পর্কে প্রচুর প্রশ্নের উত্তর পেতে এবং বাধাগুলো টপকে আসতে সাহায্য করে। শুরুর দিকে, বিষণ্ণতা ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে লড়াইয়ের বেলায় উদারমনে এসবের মুখোমুখি হওয়া আমার পক্ষে সহজ ছিল না। মনে হতো, যেহেতু অনেক মানুষের নজর রয়েছে আমার ওপর, তাই নিখুঁত বা পরিপূর্ণ হওয়ার একটা চাপে পড়ে গেছি। তবে যখন সাহায্যের সন্ধান এবং নিজ অনুভূতির প্রতি উদারমনা হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলাম, তখনই পেলাম স্বস্তির স্বাদ।
আমার ধারণা, যেহেতু আমি একজন মানুষ এবং অন্য যেকোনো মানুষের মতোই পরিপূর্ণ নই, এটিই আসলে আমার পক্ষে অন্য মানুষদের চেয়ে অধিক সুবিধার ব্যাপার।
ভবিষ্যতের সৌন্দর্য
পৃথিবীর সেরা কিছু মেকআপ আর্টিস্টের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মেকআপ শিল্প এবং ভিন্ন ভিন্ন চেহারার অভিজ্ঞতা আমার ভালো লাগে। কীভাবে তারা (মেকআপ আর্টিস্ট) একটা চরিত্রকে সম্পূর্ণ বদলে দেন, ভালো লাগে।
বছর দুয়েক আগে, সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রচলিত কথাবার্তা বদলে দিতে একটি ব্র্যান্ড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এই ইন্ডাস্ট্রির এমন কিছু দরকার, যা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি।
নিজেকে দেখতে ভালো লাগবে, এমন মেকআপ করার কথা ভাবতে অভ্যস্ত ছিলাম আমি। কিন্তু এখন বুঝি, নিজেকে সুন্দর দেখাবে- এমন অনুভব পাওয়ার জন্য মেকআপ করার দরকার নেই। এখন আমি মেকআপকে একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ভাবি এবং এ নিয়ে বেশ রোমাঞ্চিতও। আর 'রেয়ার বিউটি'র (সেলেনার কোম্পানি) মাধ্যমে আমি এ কাজই করতে চাই, যেন যতটা সম্ভব কম ও নিরাপদ মেকআপ করেও আপনি সবার সামনে স্বস্তিবোধ করেন।
একটি নির্দিষ্ট তরিকার দেখানোর এবং কথিত খুঁত লুকানোর বা ঢাকার মতো মেকআপ করার চাপ প্রবল। কিন্তু আমরা এ ধরনের আলাপকে চ্যালেঞ্জের এবং আমাদের নিজ নিজ অনন্যতাকে উদযাপনের মাধ্যমে নারী ও পুরুষদের সৌন্দর্য 'ধারণা'কে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাই।
'রেয়ার বিউটি' চালু করার পর থেকে আমার টিম ও আমি আত্মগ্রহণযোগ্যতা ও মানসিক স্বাস্থ্য ঘিরে ইতিবাচক আলাপ-আলোচনার একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলছি। করোনাভাইরাস মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কালে জুম কলের মাধ্যমে আমরা 'রেয়ার চ্যাটে' অংশ নিয়েছি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রচার করেছি। সেখানে প্রত্যেককে নিজস্ব সৌন্দর্য উদযাপনে উৎসাহ দিয়েছি আমরা।
আমি নিজের চোখে দেখেছি, এই উন্মত্ত বছরটিতে আমাদের ফলোয়ারেরা একে অন্যের সঙ্গে দারুণসব অর্থবহ সংযোগ গড়ে তুলছেন!
এই কোম্পানি গড়ার উদ্দেশ্যও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানতাম, মানসিক স্বাস্থ্যই আমাদের দেওয়া বার্তাগুলোর একটি বড় অংশ।
'রেয়ার ইমপ্যাক্ট ফান্ড'-এর মাধ্যমে আমরা মহামারিকালীন ক্রমিক একাকিত্ব চিহ্নিত করে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট 'কলঙ্ক' কমাতে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। গত জুলাইয়ে (আমার ২৮তম জন্মদিনে) আমরা ওই ফান্ড গঠন করেছি এবং আগামী ১০ বছরের মধ্যে ১০ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্য ঘোষণা দিয়েছি, যেন সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে পারি।
অন্যান্য অংশীদার ও আমাদের গোষ্ঠী থেকে তহবিল বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা প্রতীজ্ঞাবদ্ধ। 'রেয়ার বিউটি'র বার্ষিক উপার্জনের ১ শতাংশ সরাসরি 'রেয়ার ইমপ্যাক্ট ফান্ডে' যুক্ত হবে। এই ফান্ডের মাধ্যমে আমরা 'রেয়ার ইমপ্যাক্ট মেন্টাল হেলথ কাউন্সিল'ও গঠন করেছি, যেটিতে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে রয়েছেন শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি, যারা বড় ধরনের প্রভাব তৈরিতে আমাদের সাহায্য করছেন।
নিজেদের বিরল করে তুলেছে, এমন শক্তির অধিকারী প্রত্যেক মানুষের কাছে হাজির হতে চাই আমি। নিজ নিজ অনন্যতাকে আলিঙ্গন করে, অন্যদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা থামানো এবং নিজেকে আরও বেশি ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের বিশেষ করে এখন ভীষণ প্রয়োজন।
- লেখক: আমেরিকান গায়িকা ও অভিনেত্রী
সিএনএন থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ