কৃষক আন্দোলন নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীনরা কেন এত উদ্বিগ্ন
যেকোন কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ন্যায্যতার লড়াই তথা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রামে সবসময় সামনের কাতারে কৃষকদেরই পাওয়া যায়, ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাসও তাই বলে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাতও এইভাবে ছোট-ছোট দাবি আদায়ের থেকে শুরু। বিপরীতে ব্রিটিশরাও ধীরে ধীরে সরাসরি কৃষকদের দমন করার পাশাপাশি এই কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরাতে চেয়েছে, বিভিন্ন সময়ে কৃষক পরিপন্থী নীতি অবলম্বন করে। এই ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা একটা সময় পর ক্ষমতা আর টিকিয়ে রাখতে না পারলেও তাদের শোষণের লিগ্যাসি এখন অবধি বহাল তবিয়তে আছে এই উপমহাদেশে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে নেতৃত্ব দেওয়া কৃষক সমাজ স্বাধীনতার পরেও তাই হয় নিষ্পেষিত। ভারতের উত্তর প্রদেশের লাখিমপুর খেরিতে অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে জনপ্রতিনিধির গাড়ির চাকায় আন্দোলনরত কৃষকদের পিষ্ট হওয়া অন্তত তাই প্রমাণ করে।
সমসাময়িক ভারতে কৃষকদের রাজপথে নেমে আসার ঘটনা বহুবার ঘটেছে তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে মোদি সরকারের জারিকৃত বিতর্কিত তিনটি কৃষি সংস্কার আইন নিয়েও দানা বাঁধে তীব্র অসন্তোষ, সরকার যেটাকে দেখছে কৃষকদের মঙ্গল হিসেবে। তবে কৃষকরা এটাকে দেখছে কৃষি বিরোধী আইন হিসেবে যেখানে আগের মত মান্ডির উপর রাজ্যের একক প্রভাব থাকছে না, অন্যদিকে বাজারই ঠিক করে দিবে কৃষকের পণ্যের মূল্য, এতদিন "মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের" কারণে যে ভর্তুকি সুবিধা পেয়ে আসছিলো কৃষক তা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। গতানুগতিক ধারার কৃষি ব্যবস্থা বদলে রাতারাতি এই সংস্কার প্রক্রিয়া সাধারণ কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কতটা শুভ হবে সেটা বলা মুশকিল তবে কেউ কেউ বলছেন কেন্দ্র সরকার মূলত এর মাধ্যমে কৃষিখাতকে কর্পোরেট সেক্টরের হাতে তুলে দিচ্ছে, যেখানে কৃষক হয়ে উঠবে তাদের হাতের পুতুল। এমন অবস্থায় দিল্লি ঘেরাও এর ডাক দেয় ভারতের আপামর কৃষক সমাজ, পরবর্তীতে পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলে আলোচনায় বসে কেন্দ্র সরকার ও কৃষক নেতারা তাতে কোন সমাধান না আসলেও আন্দোলন ক্রমান্বয়ে দমে আসে।
তবে গত মাসে পুনরায় কৃষকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের তীর্যক মন্তব্যের পর তার উত্তর প্রদেশ সফরকে ঘিরে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ করে কৃষকরা পথে অজয় মিশ্রের ছেলে আশিষ মিশ্রের কনভয়ের মুখোমুখি হলে একপর্যায়ে গাড়িটি কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হলে ঘটনা সহিংসতায় মোড় নেয় যেখানে চারজন কৃষকসহ মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়।
এরপর, প্রথমে ঘটনা ধামাচাপা দিতে বলা হয় মন্ত্রী পুত্র সেখানে ছিল না অন্যদিকে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, ইউপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবসহ বিরোধী পক্ষের কাউকেই ঘটনাস্থলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। পাশাপাশি অনেকেই বলছেন কৃষক হত্যার বিষয়টি থেকে জনগণের মনযোগ সরিয়ে নিতে হঠাৎ করেই মাদকসহ গ্রেপ্তার হয় শাহরুখ খানের ছেলে, যেখানে আদানি গ্রুপের বন্দরে ২১ হাজার কোটি টাকার মাদক উদ্ধার নিয়ে কোন সাড়াশব্দ নেই। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠে তাহলে কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীনরা এত উদ্বিগ্ন কেন?
ভোট, নির্বাচন এবং উত্তর প্রদেশ
ক্ষমতায় থাকা নরেন্দ্র মোদিকে বলা হয়ে থাকে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ২০১৪ সালে কংগ্রেসকে প্রায় তুলোধুনো করে নিজেদের ইতিহাসের এই সেরা সময়ে বিজেপি কিংবা মোদি এমনি এমনি আসে নাই, এর জন্য তাদের পোড়াতে হয়েছে হিন্দুত্ববাদের কাঠখড়। যার দরুণ সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা বা হালের করোনা সংকট কিছুই টলাতে পারেনি মোদির জনপ্রিয়তাকে। তবে এতকিছুর পরেও সাম্প্রতিক সময়ে কৃষকদের ন্যায্য আন্দোলনের যে জনসমুদ্র দিল্লি দেখেছে তা ভড়কে দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের মন, জাতীয় পর্যায়ে তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর মত কেউ না থাকার পরেও। জাতীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে সবচে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে যার ফলাফল বরাবরই প্রভাব ফেলে লোকসভা ভোটে, এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে আবার সেই উত্তর প্রদেশেই কৃষকদের বিক্ষোভ, হতাহতের ঘটনা অবশ্যই শাসকদের জন্য চিন্তার কারণ বটে।
৪০৩ সিটের বিধানসভায় গত নির্বাচনে বিজেপি জোট ৩২৪ সিট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো, অপরদিকে সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-কংগ্রেস জোট ২৪,বহুজন সমাজবাদী পার্টি (বিএসপি) ১৯, অন্যরা ৬টি। কয়েকবছর আগেও উত্তর প্রদেশ মানেই ছিল মুলায়েম সিং যাদব আর মায়াবতীর লড়াই সেখানে হটাৎ করেই উত্থান গেরুয়া শিবিরের এমনকি ২০১২ এর নির্বাচনেও তাদের আসন ছিল মাত্র ৪৭। তবে বিজেপির এই উত্থান একটু পেছনে ফিরলে মোটেই নতুন মনে হবে না, ভারতজুড়ে তাদের রাজনীতির যে আদর্শ তার উৎস ভূমি আর চর্চার জায়গা এই উত্তর প্রদেশ। বাবরি মসজিদ থেকে রাম মন্দির, সাধারণ মানুষে সাম্প্রদায়িকতা উষ্কে দিয়ে ভোটের মাঠে ফায়দা আদায় করেছে বিজেপি আর বিপরীতে ভারতের অন্যতম দরিদ্র এই প্রদেশের মানুষ জীবনমানে পিছিয়েছে আরো। উত্তর প্রদেশে বিজেপির এই যাত্রার সারথি যোগী আদিত্যনাথ আবার এমন একজন যিনি কাজেকর্মে বিজেপির চেয়েও বেশি ডানপন্থী। রাজ্যে করোনা পরিস্থিতি ও এর ব্যবস্থাপনা ভয়াবহ সংকটে উপনীত হলেও দলের নীতিনির্ধারক থেকে জনগণের কাছে তিনি এখনো আস্থার প্রতীক তার মুসলিমবিরোধী অবস্থানের জন্য। জরিপ বলছে বিজেপির জনপ্রিয়তা কিছুটা নিম্নগতির দিকে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারাই সরকার গঠন করবে। তবে চলমান এই কৃষক অসন্তোষ বিজেপির জন্য পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুললো, কেননা মানুষ যতই "প্রোপাগান্ডা-রেটোরিক" নিয়ে লাফালাফি করুক দিনশেষে কৃষি না বাঁচলে বাঁচবে না দেশ। মোদি, অমিত শাহরা ভালো করেই জানেন উত্তর প্রদেশে একবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে আবার হিন্দুত্ববাদের ধুয়ো তুলে জনমত তৈরি করা বেশি কঠিন হয়ে পড়বে যার প্রভাব গিয়ে পড়বে সোজা কেন্দ্রের মসনদে।
তবে বিজেপির জন্য আশার খবর হচ্ছে তাদের সময় যত খারাপই হোক, তাদেরকে টক্কর দেওয়ার মত একক শক্তিশালী কোন দল বা মুখ উত্তর প্রদেশ তথা গোটা ভারতে এই মুহুর্তে নেই। কিংবা ইউপিতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও কোন জোট তৈরির সমূহ সম্ভাবনা নাই, জরিপ বলছে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী দল আগের বারের চেয়ে এবার আরো ভালো করলেও তা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট নয় বিপরীতে বহুজন সমাজবাদীর মায়াবতী দলিত ভোটে এগিয়ে থাকলেও আসনের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছেন, জরিপে কংগ্রেসের অবস্থান একেবারে তলানীতে। তবে মায়াবতী-অখিলেশ দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারলে তা বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য যথেষ্ট হবে আর বাস্তবতা বলছে এমন কোন সম্ভাবনাও খুব একটা নেই।
দিনশেষে বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই হয়ত আবার ২২ এর নির্বাচনের মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের জনগণের ভাগ্য বদলানোর ম্যান্ডেট পাবেন তবে সাথে সাথে তাদের কৃষকের ভাগ্যের ভালো-মন্দও মাথায় রাখতে হবে কারণ ইতিহাস বলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।