ভারতের কৃষক আন্দোলন থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা কী?
"আপনারা এবার ঘরে ফিরে যান"- ভারত জুড়ে ১ বছর ৩মাস ধরে চলা আন্দোলনরত কৃষকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শিখ ধর্মগুরু নানকের জন্মদিনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদে পাশ করানো হয়েছিল এই তিন কৃষি আইন। ওই বিতর্কিত তিনটি আইনের বিরুদ্ধে প্রায় এক বছর রাজধানী দিল্লির প্রবেশপথে কয়েক লক্ষ কৃষক বিক্ষোভ অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। টানা এই আন্দোলনে মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের কৃষকরা অবস্থান করছেন। এই রাজ্যগুলোতেই সামনের বছরের শুরুতে বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি বিরোধীরা খোঁচা দিতেও ছাড়লেন না। কেউ বললেন, অবশেষে হার মানলেন নরেন্দ্র মোদী। কেউ বললেন, কৃষকদের জয়। কংগ্রেস বলল, বিলম্বিত বোধোদয়, অহঙ্কারের পতন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একাধিক নতুন বিল নিয়ে এসেছে মোদী সরকার। তবে ২০২০-এর সেপ্টেম্বরে মোদী সরকারের নিয়ে আসা তিনটি কৃষি বিল নিয়ে যে বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল তা বোধহয় আর কোনও বিলকে ঘিরে হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত কৃষকদের লড়াইয়ের কাছে মাথা নত করল মোদী সরকার।
ভারতের কৃষি আইন বাতিলের আন্দোলনের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। আমাদের রাজনৈতিক মহলের মনোযোগের কারণ নানাবিধ। ভারতের কৃষির সাথে আমাদের কৃষির অনেক তফাৎ থাকলেও মিল অনেক। আমাদের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৬ শতাংশ; ভারতেও তাই। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সকল দেশের কৃষি জাতীয় উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আমাদের শ্রমশক্তির ৪৩ শতাংশ যুক্ত কৃষি কাজের সাথে। ভারতে এই হার আরো বেশি। ভারতের ৫২ শতাংশ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। তবে ভারতের অর্থনীতি, জিডিপি ও কৃষি আমাদের তুলনায় আকারে অনেক বড়। ভারতের কৃষি আমাদের তুলনায় অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ।
দুগ্ধ, কাজুবাদাম, নারিকেল, চা, পাট, আদা, হরিদ্রা ও কালো মরিচ, আম, লেবু, পেঁপে, ফুলকপি , উৎপাদনে ভারতের স্থান বিশ্বে প্রথম। কফি উৎপাদনে ভারতের স্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। গবাদি পশুর সংখ্যার হিসেবেও ভারতের স্থান বিশ্বে প্রথম। গম, ধান, আখ, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ ও অন্তদেশীয় মৎস্য উৎপাদনে ভারতের স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। তামাক উৎপাদনে ভারতের স্থান বিশ্বে তৃতীয়। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ফলের ১০ শতাংশ ভারতে উৎপাদিত হয়। কলা উৎপাদনেও ভারতের স্থান বিশ্বে প্রথম। তবে ভারতে ধান ও গম উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সংকট কেবল ভারতে নয় এটা বৈশ্বিক সমস্যা। কৃষি নিয়ে তাই পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্ত নেই। একসময় কৃষি কেবল নিজস্ব প্রয়োজন মাথায় রেখেই উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করত। আর এখন, বিশ্ববাজারে চাহিদার কথা মাথায় রেখে কৃষি পণ্য উৎপাদন করা হয়। কৃষক কী উৎপাদন করবে বা কতটুকু করবে তা এখন নির্ধারণ করে বাজার। তা দেশি বাজার হোক বা আন্তর্জাতিক বাজার হোক। এটা এখন আর কৃষকের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। এখন এক ইঞ্চি জমি অনাবাদি রাখার উপায় নেই।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে তাল মিলাতেই ভারতে কৃষি আইন তিনটি করা হয়েছিল। মোদী সরকারের দাবি, তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে এই তিনটি কৃষি আইন কার্যকর করা হচ্ছে। ১. কৃষিক্ষেত্রে ফড়ে বা দালালদের আধিপত্য কমিয়ে কৃষকের আয় বাড়ানো। ২. রাজ্যগুলোতে চুক্তি-ভিত্তিক চাষের ব্যবস্থা আইনসিদ্ধ করা। ৩. কৃষিপণ্য বিপণন নিয়ে যে আইন রয়েছে তা দূর করে আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেওয়া। কিন্ত ভারতের কৃষক সরকারের এই দাবির সাথে একমত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, 'আমরা কৃষকদের বোঝাতে সক্ষম হইনি'।
প্রথম আইনটি, 'অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) আইন' বা 'দ্য এসেনসিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেডমেন্ট ) অ্যাক্ট'।
এই আইনের মাধ্যমে কৃষক সরাসরি বড় ব্যবসায়ীর কাছে তার পণ্য বিক্রি করতে পারবে। কোন দালাল বা ফড়িয়া দরকার হবে না। কৃষক প্রকৃত দাম পাবে এবং কৃষকের আয় বাড়বে। কিন্তু কৃষকরা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের কথা হল, অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরাসরি কৃষকদের থেকে কৃষিপণ্য কিনে মজুত ও বিক্রির অধিকার দেওয়া হলো। আন্দোলনকারী কৃষক এবং বিরোধীদের অভিযোগ, এই আইনের মধ্য দিয়ে সরকার কৃষি পণ্যে যে সহায়ক মূল্য দেয় তা তুলে নিতে চায়। কৃষকের উৎপাদিত কৃষি পণ্য কেনার দায় সরকার নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কৃষকদের আশঙ্কা ব্যবস্থাটি বেসরকারি সংস্থা ব্যবসায়ীদের হাতে গেলে সহায়ক মূল্য পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া থেকে সরকার চাল, ডাল, গম, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীর মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বলে কিছু না রাখায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ঘুরপথে চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে।
দ্বিতীয় আইনটি 'কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন' বা 'ফারমার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফ্যাসিলিয়েশন) অ্যাক্ট'।
সরকার বলছে, এই আইনের ফলে কৃষক তার এলাকার মান্ডির বাইরেও ফসল বিক্রি করতে পারবে। এখন কৃষকের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য মান্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন হাত ঘুরে বড় ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছাতো। নুতন আইনের ফলে বড় ব্যবসায়ী বা বেসরকারি কোনও সংস্থা চাইলে সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনে নিতে পারবে। কৃষক আপত লাভবান হবে সত্য কিন্তু মান্ডি ব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে। মান্ডি ব্যবস্থায় কৃষক যে সুরক্ষা পেত তার অবসান ঘটবে এবং সেই সুযোগে বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি কৃষকদের ক্রমাগত ঠকানোর সুযোগ পাবে।
তৃতীয়টি 'কৃষক সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন (মূল্য এবং কৃষি পরিষেবা সংক্রান্ত) আইন' বা 'ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট'।
এই আইনের মাধ্যমে কৃষক চুক্তিনির্ভর চাষ করতে পারবেন। কৃষক আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ীর সাথে শস্যের দাম নির্ধারণ করে নিতে পারবেন। অন্যদিকে এই আইন অনুযায়ী কোনো বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থা বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা চাইলে কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেই জমিতে কৃষিজ পণ্য ফলাতে পারবে। জমির চুক্তি অনুযায়ী কৃষক দাম পেয়ে যাবেন। কৃষক নিজের জমিতে কাজ করতে চাইলে, তার জন্য দৈনিক পারিশ্রমিকও মিলবে। সরকারের যুক্তি, এতে দেশীয় কৃষিজ পণ্যের চাহিদা বাড়বে।
কৃষি পণ্য রপ্তানির পথ প্রশস্ত হবে। বিরোধীদের বড় আশঙ্কা হল, চুক্তির খেলাপ হলে প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নেই। বড় ব্যবসায়ীদের সাথে আইনী লড়াইয়ে কৃষক টিকতে পারবে না। কৃষকের স্বার্থহানি ঘটলেও সে লিজ দিতে বাধ্য হবে, এমন কি, কৃষক ভূমি থেকে উচ্ছেদও হয়ে যেতে পারে। অতীতের অনেক উদাহরণ সামনে এনে কৃষকরা বলছেন, এই আইনে কৃষক নিজের জমিতে ক্রীতদাস হয়ে যাবে এবং জোর করে জমি কেড়ে নেওয়া হবে।
আমাদের পাশের দেশের কৃষকরা দীর্ঘ ১৫ মাস লাগাতার আন্দোলন করল, বহু মানুষ জীবন দিল। সহস্রাধিক মামলা হল কিন্তু আমাদের দেশের কৃষক সংগঠনগুলোর তেমন নড়াচড়া পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদের দেশের কৃষক আন্দোলন এখনো সার, বীজ, সেচের জ্বালানি দাম কমাতে হবে বা কৃষি পণ্যের দাম বাড়াতে হবে এর বাইরে তেমন চিন্তা লক্ষ্য করা যায় না।
বিশ্বের সকল দেশ কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। প্রতি বছর মোটা টাকার সহায়তা দেওয়া হয় কৃষিতে। কৃষির সাথে বিপুল এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত। সেকারণেই সহায়তা এবং সক্ষমতার প্রশ্নটি পাশাপাশি আলোচনা হওয়া দরকার। কৃষিকে বাজারের সাথে খাপ খাওয়ানো বা প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে কী ধরনের আইন বা সংস্কার প্রয়োজন, সে আলোচনা দেখি না। ভারতের কৃষি আইন প্রত্যাহারের খবর মিডিয়াতে প্রধান শিরোনাম। সোশাল মিডিয়াতে আন্দোলনকারিদের অভিনন্দনের বন্যা। এটা সত্যি অভূতপূর্ব ঘটনা। দীর্ঘ ১৫ মাস নারী পুরুষ নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে শত শত মাইল দুরে দিল্লিতে এসে মাটি কামড়ে আন্দোলন করে সফলতা অর্জন অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য।
আমাদের জন্য ভারতের এই কৃষি আন্দোলনের শিক্ষা কী? সহায়তা দিয়েই কৃষি বাঁচবে নাকি প্রতিযোগিতা সক্ষম করা হবে। ১৮ কোটি জনগোষ্ঠি। প্রতিবছর চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ কমছে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বহুমুখিকরণ এখন আমাদের উপযুক্ত বিকল্প। কৃষিতে বড় বিনিয়োগ এখন সময়ের প্রয়োজন। বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতের কৃষক আন্দোলনে ব্যক্তি খাতকে নিয়ে যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তা হয়ত অমূলক নয়।
আইনের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ছোট কৃষকের স্বার্থ কিভাবে রক্ষিত হবে তার জন্য উপযুক্ত আইন থাকতে হবে। কৃষক স্বার্থ সুরক্ষার উপায়গুলো নিয়েই এখন আলোচনা হওয়া দরকার। দিন শেষে যেন উভয় পক্ষ উইন উইন অবস্থার মধ্যে আসতে পারে। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসনে এটি যথাযথ বিকল্প।