কৃষক বিদ্রোহের আগুন কতোটা পোড়াবে মোদি সরকারকে?
গেলো বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের ক্ষমতাসীন মোদি সরকার কৃষিখাত সংস্কারে তিনটি বিতর্কিত আইন পাশ করেছে, যা দেশটির কৃষকসমাজে চূড়ান্ত অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কৃষকরা 'দিল্লি চল' আন্দোলনের ডাক দেন এবং গত ২৬ নভেম্বর থেকে তারা দেশটির বিভিন্ন প্রদেশ, বিশেষত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে দিল্লি ও এর সীমান্তে অবস্থান করছেন।
দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজেদের ট্রাক্ট্রর, ট্রলিতে করে কয়েকমাসের খাবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে শীতের রাতে তাবু টাঙিয়ে থাকার প্রস্তুতি নিয়েই দিল্লির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন তারা। যাত্রাপথে তাদের সহ্য করতে হয়েছে পুলিশের লাঠিপেটা, জলকামানসহ আরও নানারকম বাঁধা। তারপরেও নিজেদের দাবি আদায়ে দুইমাসেরও বেশি সময় ধরে নতুন আইনের বিরূদ্ধে বিদ্রোহী অবস্থানে অটল রয়েছেন তারা। তবে এই আন্দোলন যেনো খুব বড় ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে মোদি সরকার যথেষ্ট তৎপর।
তবুও এরমধ্যে গত মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানের দিন সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লিতে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার কৃষক এবং দিল্লির প্রাণকেন্দ্র ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় উড়িয়ে দেয় শিখ ধর্মের প্রতীক খালসা পতাকা। এ নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় কৃষকরা যাতে প্রাণ যায় এক কৃষকের।
শুক্রবার (২৯ জানিয়ারি) ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সীমান্তে অবস্থান করেই ফের দিল্লি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন কৃষকরা। ইতোমধ্যেই বিতর্কিত এই তিন আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির উপকণ্ঠে আন্দোলনরতদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও কয়েক হাজার কৃষক।
দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধস্তাধস্তির পর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই এ কৃষকরা যোগ দেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। কর্তৃপক্ষ দিল্লির পূর্ব অংশের একটি স্থান থেকে কৃষকদের তুলে দিতে চাইলেও সফল হতে পারেনি। আন্দোলনরত কৃষকরা জানিয়েছেন, তারা এক পা'ও পিছু হটবেন না।
কৃষকদের তীব্র আন্দোলনের মধ্যে গত ১২ জানুয়ারি বিতর্কিত এই তিনটি আইন স্থগিত রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় ভারতের শীর্ষ আদালত। তবে আইনগুলো বাতিলের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলন চালিয়েই যাচ্ছেন।
সরকারপক্ষের দাবি, নতুন তিন আইন কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করবে। উৎপাদিত ফসল বিক্রয়ে তারা পূর্ণ স্বাধীনতা পাবেন। কিন্তু কৃষকদের ভয় সরকার গুটি কয়েক শিল্পপতি এবং বড় বড় কর্পোরেশন গুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে এমন কৃষকবিরোধী আইন পাশ করেছে যেখানে ফসলের সরকার নির্ধারিত মূল্য থাকছে না। এমনকি কৃষিপণ্যের সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থারও (মান্দি ব্যাবস্থা) বিলুপ্তি ঘটবে এমনটা আশঙ্কা করছেন ভারতীয় কৃষকেরা। অর্থাৎ নতুন আইন অনুযায়ী বাজারের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা নির্ধারিত মূল্যে ফসল কেনার দায়িত্ব থাকছে না। সরকার নিয়ন্ত্রিত মান্দি ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে এর মাধ্যমে। কর্পোরেশন বা ফড়িয়ারা নিজেদের সুবিধা মত দাম ধরে ফসল ক্রয় করবে। ইচ্ছেমত পণ্য গুদামজাত করবে। ফলে কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। কৃষকদের এমন শঙ্কা এবং বিদ্রোহের মুখেও সরকার আইন বাতিল না করার সিদ্ধান্তেই অটল রয়েছে যা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও প্রভাবিত করছে। ইতোমধ্যেই বিজেপির এমন অনড় অবস্থানের বিরুদ্ধে এবং কৃষকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ভারতের ১৬টি রাজনৈতিক দল; কংগ্রেস ছাড়াও যেখানে আছে বিজেপি'র একসময়কার রাজনৈতিক মিত্র শিবসেনা।
নতুন আইন অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের পণ্য গুদামজাতকরণকে বৈধ করা হয়েছে, যেটা পূর্বে অপরাধ হিসেবে গণ্য হত। আইন বাস্তবায়িত হলে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কমদামে কৃষিপণ্য কিনে গুদামজাত করে রাখতে পারবে এবং সময়মত কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সেই পণ্য আবার চড়া মূল্যে বিক্রি করে অধিক লাভবানও হতে পারবে। এছাড়া কোনো সমস্যা নিয়ে কৃষকদের আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না এই আইনের অধীনে। উদ্ভূত যেকোনো সমস্যার সমাধান করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটগণ। ফলে কৃষকদের ভয় ম্যজিস্ট্রেটরা সহজেই বড় বড় কর্পোরেশন, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রভাবিত হতে পারেন। এমনকি মাঠে ফসলের গোড়া পোড়ানোকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে দেখানো হয়েছে নতুন আইনে। এমন অপরাধের জন্য জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। মোটকথা কৃষকের শঙ্কা, নতুন কৃষি আইনের মাধ্যমে মোদি সরকার তাদের হাত পা বেঁধে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জিম্মি করে ফেলেছে।
কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং নতুন আইনে কৃষিপণ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কৃষক প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু প্রতিনিধিরা সরকারের এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তারা নতুন তিন আইনকে 'কালো আইন' আখ্যায়িত করে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতে গত ২৪ ডিসেম্বর বিতর্কিত কৃষি আইন নিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছে দুই কোটি কৃষকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি দিয়েছেন ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি কৃষকদের স্বার্থে এই আইন প্রত্যাহার করতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
বিতর্কিত এই আইন বাতিলের বিষয়ে সরকার যে মোটেও রাজি নয়, তা শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) দেশটির রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের ভাষণে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, নতুন এই আইনে ১০ কোটি কৃষক উপকৃত হবেন। ভাষণে লালকেল্লায় হাঙ্গামার তীব্র নিন্দা করা হয়। তবে ভারতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের দেওয়া এই ভাষণ বর্জন করেছে বিরোধী দলগুলো।
ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ১৫ শতাংশ এবং দেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ (১.৪ বিলিয়ন) অর্থ্যাৎ, জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশী মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে কৃষিখাত। তবে নতুন আইনের ফলে সৃষ্ট অসন্তোষ এই খাতকে যেমন হুমকির মুখে ফেলেছে তেমনি তৃণমূল পর্যায়ে নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপির জনপ্রিয়তাও মুখথুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক গতিহীনতা, হিমালয় সীমান্তে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু, নেপালের সাথে সীমানা দ্বন্দ্ব, রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া, রাজ্য সরকারের অসন্তোষসহ নানা চড়াই উৎরাইয়ের পরও নরেন্দ্র মোদির তৃণমূলদের নেতা হিসেবে যেই সুখ্যাতি ছিল তা অনেকেটাই এখন তোপের মুখে পড়েছে। কৃষি প্রধান দেশে যেখানে শ্রমশক্তির অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজে নিয়জিত সেখানে কৃষকদের দাবি না মানায় মোদি সরকার দেশে বিদেশে সব জায়গায় সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে।
ডিসেম্বরের শুরুতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতীয় কৃষকদের ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সমর্থন জানান। এর প্রেক্ষিতে ভারতের মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স থেকে কানাডিয়ান দূতাবাসকে সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়। বার্তায়, বলা হয় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো কর্তৃক এমন মন্তব্য কানাডায় ভারতীয় কৃষক আন্দোলন সমর্থনকারীদের 'সাহস' জুগিয়েছে যা কানাডাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এমন বার্তার প্রেক্ষিতে ৪ ডিসেম্বর প্রাধানমন্ত্রী ট্রুডো আবারো তার অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, "কানাডা সবসময় বিশ্বের যেকোন প্রান্তে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এবং মানবাধিকারকে সমর্থন করবে।"
অর্থাৎ চলমান কৃষক বিদ্রোহ শুধু ঘরেই নয়, বহির্বিশ্বেও মোদি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে। ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কানাডা সরকারের এমন মন্তব্য তারই সাক্ষ্য বহন করছে। সেই সঙ্গে উদীয়মান সুপার পাওয়ার চীনের সাথে ভারতের কোন্দল তো আছেই, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মোদি সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারছে না বলেই মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের সাথে সীমান্ত সমস্যায়ও ভারত খুব একটা সুবিধা করতে পারছেনা। কালাপানি, লুম্পুলেখ, লিমপিয়াধুরা এই তিনটি অঞ্চলের মালিকানা ভারত ও নেপাল উভয় দেশই দাবি করে আসছে। সম্প্রতি নেপাল এই অঞ্চলগুলোকে নিজের দাবি করে নতুন মানচিত্রও প্রকাশ করে যার ফলে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। ঐতিহাসিকভাবে যেখানে নেপালকে 'ল্যান্ডলকড কান্ট্রি' হিসেবে ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সমুদ্রবন্দরের উপর নির্ভশীল হতে হত সেখানে সম্প্রতি নেপাল নিজেকে 'ল্যান্ডলিংকড কান্ট্রি' হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। এর মাধ্যমে ভারতের উপর থেকে নেপালের ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত নির্ভশীলতা কমে আসবে। নেপালের কৌশলগত এমন পরিবর্তনেও ভারতের তেমন মাথাব্যাথা না থাকাটাও মোদি সরকারের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবিচক্ষণতার পরিচয় বহন করতে পারে। মোদ্দাকথা, চলমান কৃষক বিদ্রোহ ভারতের অন্যান্য ইস্যুগুলোকে সামনে তুলে নিয়ে আসতে পারে যা মোদি সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে যথেষ্ট।
১৮ ডিসেম্বর কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেন অমরজিৎ সিং নামের ভারতীয় এক আইনজীবী। রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে তিকরি সীমান্তে কৃষক আন্দোলনস্থলের কাছাকাছি এ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত চিরকুটে লেখা ছিলো- ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের করা নতুন কৃষি আইনের প্রতিবাদে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থন জানিয়ে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে করেছেন। জনগণের কণ্ঠস্বর শুনতে নরেন্দ্র মোদির সরকার যাতে বাধ্য হয়, সেই জন্য তার এই জীবনদান।
এছাড়াও ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে দিল্লির সিংঘু সীমান্তের কাছে সন্ত রাম সিং নামের ৬৫ বছর বয়সী শিখ ধর্মপ্রচারক ও আন্দোলনকারী আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনিও চিরকুটে লিখেছিলেন, কৃষকদের দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ওই ঘটনার কয়েক দিন পর পাঞ্জাবে আরও এক কৃষক আত্মহত্যা করেন।
দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে, বিশেষত ঋণের চাপে এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার করণে ভারতে প্রতিবছর গড়ে ১২ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে থাকেন।
যেদেশে অর্থনীতি একটি বড় অংশ কৃষির উপর নির্ভশীল সেখানে কৃষকদের বিভিন্ন প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করার বদলে বর্তমান ভারত সরকার যা করছে তা নেহাত নিন্দনীয়। সরকারের এমন কট্টরপন্থী আচরণকে অনেকটা বাণিজ্যিক উপনিবেশিকতাবাদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে অল্প সংখ্যক ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষায় কৃষকদের ন্যায্য দাবি আদায় থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর শাসকগোষ্ঠী এই অন্যায়ের পথ সুগম করে দিয়ে অজান্তেই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতায় আঘাত করে যাচ্ছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর নতুন আইন সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে এক শুনানিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদে বলেন, সরকারকে আশ্বস্ত করতে হবে যে তারা কৃষকদের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কিছু করবে না। সরকারের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, "আপনাদের আলোচনা আবারও ব্যর্থ হবে কারণ তারা রাজি হবে না। আমাদের সামনে আসতে পারে এমন সংগঠনগুলোর নাম দিন… এটি শিগগিরই জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হবে আর আলোচনার মধ্য দিয়েই এর সমাধান হতে হবে।"
সরকারের এমন কঠোর মনোভাব এবং দাবি আদায়ে কৃষকদেরও অনড় অবস্থা ১৯'শতকের নীল বিদ্রোহের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময়েও দরিদ্র নীলচাষীরা নীলকর কুঠিয়ালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলো। বছরের পর বছর ধরে চলা লাট সাহেবদের অবিচার আর নীলকরদের অত্যাচারে তৎকালীন বাংলার ৪৮ টি জেলার নীলচাষীরা একযোগে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। সেই বিদ্রোহে বাংলার সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষের সমর্থন ছিলো। এসময় চাঁদপুরের হাজি মোল্লা বলেছিলেন- "নীলচাষ থেকে ভিক্ষা উত্তম"। প্রথম দিকে অহিংসভাবে শুরু হওয়া আন্দোলন পরবর্তীতে সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। চরম অসন্তোষ ও বিদ্রোহের মুখে ১৮৬০ সালে সরকার বাধ্য হয়েছিলো নীল কমিশন (তদন্ত কমিটি) গঠন করতে। ১৮৬২ সালে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, অগ্রিম অর্থ সহায়তা (দাদান পদ্ধতি) দিয়ে চাষীদের জিম্মি করে রাখা, নীলচাষে চাষীদের বাধ্য করা সহ সকল অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। ফলাফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার নীল গাছের দাম বাড়িয়ে দেয় এবং নীলকররা লোকসানে পড়ে উপমহাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এভাবেই ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহের মাধ্যমে জয় হয়েছিলো তৎকালীন অসহায় দরিদ্র কৃষকদের। শ্রমিক-মজুর শ্রেণী সহ্য সীমার চরম পর্যায়ে উঠে যখন বিদ্রোহ শুরু করে, সে চরম বিদ্রোহ শাসক শ্রেণীর সিদ্ধান্তকে পদদলিত করে শ্রমিকদের জয় বয়ে নিয়ে আসে। উপমহাদেশের নীল বিদ্রোহ যেন কার্ল মার্কসের এমন মতবাদেরই সাক্ষ্য বহন করেছে।
কৃষকদের প্রতি মোদি সরকারের নব্য উদারনীতি সমর্থক মুক্তবাজার ব্যবস্থা অদূর ভবিষ্যতে বিজেপির জন্য খুব বেশি সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয়না। কেননা জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশের মতামত এবং দাবি দাওয়াকে অগ্রাহ্য করে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার কখনো সফল হতে পারেনা। 'বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত' এই ট্যাগ লাইনটি মোদি সরকার কতটুকু কার্যকরভাবে ধরে রাখতে পারে সেটাই এখন দেখার পালা।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।