গ্রেটা থুনবার্গ: জলবায়ু রক্ষার ‘জোয়ান অব আর্ক’
সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনের রাস্তায় বসে আছেন এক কিশোরী, একদম একা। হাতে একটা প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট’।
২০১৮ সালের সে সময়টায় তীব্র তাপপ্রবাহ ও দাবানলে সুইডেনের অবস্থা ভয়াবহ। জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না- এর প্রতিবাদে ওই কিশোরী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ২০ আগস্ট থেকে টানা তিন সপ্তাহ সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে থাকলেন তিনি।
এই ধর্মঘটের সময় তিনি যে চুপটি করে বসে ছিলেন তা নয়। আশপাশের মানুষদের মাঝে লিফলেটও বিতরণ করেছেন। যেখানে লেখা ছিল: “আমি এটা করছি কারণ তোমরা বড়রা আমার ভবিষ্যত ধূলিস্যাৎ করে দিচ্ছ।”
তিনি তার এই প্রতিবাদের কথা ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে পোস্ট করে ক্রমান্বয়ে জনমত তৈরি করতে থাকেন।
১৬ বছর বয়সী কিশোরী গ্রেটার এই আন্দোলনই পরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বুনো দাবানলের মতো।
এ বছরের ১৫ মার্চ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে #FridaysForFuture ট্রেন্ডের মাধ্যমে স্কুলগুলোতে বিক্ষোভের আয়োজন করেন গ্রেটা। এদিন তার ডাকে সাড়া দিয়ে জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ ১০৫টি দেশের ১,৬৫৯টি স্থানে শিক্ষার্থীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ ও মিছিল করেছে। সবাই নিজের নিজের কমিউনিটিতে গড়ে তোলেন প্রতিবাদের আন্দোলন যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ‘Fridays for Future’ আন্দোলন নামে।
জলবায়ু রক্ষায় গ্রেটার এই আন্দোলন ও বিশ্ববাসীর কাছে তার এই গ্রহণযোগ্যতা গ্রেটাকে এনে দিতে পারে ২০১৯ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার।
গ্রেটার এই অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ববাসী। এ বছরের মে মাসে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হয় তাকে নিয়ে, শিরোনাম: ‘নেক্সট জেনারেশন লিডার’ (পরবর্তী প্রজন্মের নেতা)। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম তরুণ প্রজন্মের উপর গ্রেটার এই প্রভাবকে নাম দিয়েছে ‘গ্রেটা থুনবার্গ ইফেক্ট’।
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বক্তৃতা দিয়েছেন গ্রেটা। এর মধ্যে রয়েছে, পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন এবং জাতিসংঘের (ইউএন) জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে।
গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ২৪তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে এই দৃপ্ত কিশোরী বলেন, “আমি এখন জলবায়ুর ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলি।”
“শুধুমাত্র ধনীদের আরাম-আয়েশে দিন কাটানোর সুযোগ করে দিতে আমাদের জলবায়ুর ক্ষতি করা হচ্ছে। অনেকে মিলে অল্প কয়েকজনের বিলাসিতার খেসারত দিচ্ছে।”
গ্রেটা শপথ নেন, “আমি এখানে এসেছি সবাইকে জানিয়ে দিতে যে, সবকিছু বদলানো প্রয়োজন এবং আজ থেকে এই বদলানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বিশ্ববাসী জেগে উঠছে। আর আপনাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, পরিবর্তন আসবেই।”
এ বছরের ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে হাজার হাজার লোক জড়ো হন ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ আন্দোলনে সহমর্মিতা জানিয়ে। এরপর থেকেই মূলত বিশ্বজুড়ে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গ্রেটার নাম।
এদিন গ্রেটা তার বক্তব্য শুরু করেন এভাবে, “এই মুহূর্তে আমরাই আছি যারা পরিবর্তন করতে পারি। কেউ যদি এগিয়ে না আসে, উদ্যোগ না নেয়, তবে আমরাই করব। একসঙ্গে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার বিকল্প নেই।”
গ্রেটার এই আন্দোলনের ফলও কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জার্মান সরকার গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে ৫৪ বিলিয়ন ডলার অনুদান বরাদ্দের প্রতিজ্ঞা করেছে।
লক্ষ্যণীয় যে, সুইডেনে শুরু হলেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী, ইউরোপের সীমানা পেরিয়ে সর্বত্র। গ্রেটার এই আন্দোলন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশেও। তাই ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে জড়ো হয়েছিলেন শত শত শিশু-কিশোর। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড। যাতে লেখা, ‘ক্লাইমেট স্ট্রাইক ইন বাংলাদেশ’।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া ফারিয়া সিফাত রায়না আন্দোলনকারীদের একজন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে এসেছে থুনবার্গ। তার সেই প্রতিবাদের ডাকে সাড়া দিতেই আজ এখানে জড়ো হয়েছি আমরা।”
গ্রেটা থুনবার্গ ‘জলবায়ু যোদ্ধা’ হয়ে উঠলেন কী করে?
২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে গ্রেটা বললেন, “সারাবিশ্বে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। আমাদের পরিবেশ আর বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা মুখোমুখি হয়েছি এক বিপুল ধ্বংসের আর আপনারা কি না ছুটছেন টাকার পেছনে? অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফাঁপা রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন আমাদের? আপনাদের এত দুঃসাহস?”
কন্ঠে তার আবেগ কিন্তু দুর্বলতা নেই একফোঁটাও।
এই বয়সে জলবায়ু আর পরিবেশের পক্ষ নিয়ে দাঁড়ানো সহজ নয়, অনেক সাহস আর মনোবল লাগে এর জন্য।
সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে শুরু হওয়া গ্রেটার এই আন্দোলন হারিয়ে যেতে পারত, একটা ব্যর্থ চেষ্টায় পরিণত হতে পারত। কিন্তু গ্রেটা সাধারণ মেয়ে নন। তার মনোবল আর দৃঢ়তা এতই শক্তিশালী যে, হারিয়ে যাওয়া তো দূরে থাক, বরং তা উৎসাহিত করেছে বিশ্বের সকল মানুষকে।
মহামারী জলবায়ু সংকট নিয়ে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা
মেরু অঞ্চলের গ্লেসিয়ার আর বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি প্রচণ্ড দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে অরণ্য, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি প্রাণ।
যদি বিশ্বজুড়ে শিল্পায়ন আর অযৌক্তিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লোভের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে জলবায়ু সংকট আসতে পারে মহামারী রূপে, এমনটাই জানালেন বিজ্ঞানীরা। নয়তো সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন প্রকৃতি নিজেই আমাদের বিরুদ্ধে এর প্রতিশোধ নিতে শুরু করবে।
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ডই পরিবেশের এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। সম্প্রতি আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগার ঘটনা এরই এক উদাহরণ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা ও জরিপের ফল বলছে, উত্তর আমেরিকা আর এশিয়ায় পাখিরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। শুধু উত্তর আমেরিকায় ১৯৭০ সাল থেকে এই পর্যন্ত হারিয়ে গেছে ৩০ শতাংশ পাখি। প্রতিদিন বিশ্বের জীবজগত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ২০০ প্রজাতির প্রাণি।
তবে উন্নত বিশ্বের ডানপন্থী নেতারা বিজ্ঞানীদের এই হুঁশিয়ারি বার্তা আমলেই নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বলে কিছু নেই, এগুলো সব রূপকথার গল্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বলেই দিলেন, “বিজ্ঞানীদের বেশ বড়সড় রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে।”
বিশ্বনেতারা যেখানে জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি অস্বীকার করছেন, তখন একজন গ্রেটা থুনবার্গের খুব দরকার ছিল। জোয়ান অব আর্কের মতোই গ্রেটাও বেরিয়ে এসেছেন তার দুনিয়া থেকে। নেমেছেন বিশ্বের জলবায়ু আর এখানকার মানুষদের রক্ষার লড়াইয়ে।