চীন ও মার্কিন চাপ কূটনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ
করোনাকালে কূটনৈতিক অঙ্গনেও হঠাৎ উত্তাপ ছড়ালেন চীনের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও চীনা রাষ্ট্রদূত পরস্পর বিরোধী অবস্থানে। চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ইতিহাসের সকল নজির ভঙ্গ করে বাংলাদেশের বিষয়ে এমন একটি মন্তব্য জুড়ে দিলেন যা পৃথিবীর সকল কূটনীতিকের কাছে বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে উপস্থাপিত হলো। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীন আমাদের বিরোধিতা করলেও গত ১০ বছরে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায়নের পরেই তীব্র সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে। বিশ্ব ব্যাংক ও জাইকা দুর্নীতির অভিযোগ উপস্থাপন করে অর্থায়নের পদক্ষেপ থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংকটময় বিষয়। পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় জীবনের এক বড় আবেগের বিষয়। সেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিল বিশ্ব ব্যাংক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সেই পদক্ষেপকে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তায় আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। আমরা নিজেরা অর্থায়ন করলেও এই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের কারিগরি বিষয় সম্পূর্ণভাবে চীন নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল। এ নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে বিতর্ক আছে। অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চীনের অতিরক্ত সময়ক্ষেপণে ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি।
এরপর চীন আরো বেশকিছু অবকাঠামো উন্নয়নে হাত প্রসারিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচলিত ঢঙেই বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করার জন্য নানান কৌশল, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। তারই অংশ হিসেবে চীনের বিরুদ্ধে কোয়াড নামক একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে। কোয়াড শব্দটি একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ৪। কোয়ারড সদস্য হচ্ছে জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন বিরোধী এ সামরিক জোটে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে। সেই লক্ষ্যেই জো বাইডেনের প্রতিনিধি হিসাবে জন কেরি কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন বলেই ধারণা করা হয়। জন কেরির পরে পরেই আমাদের দেশে এসেছিলেন চীনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি, চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
বাংলাদেশ কি আদৌ এই ধরনের সামরিক জোটে যোগ দিতে পারে কিনা? এটি পর্যালোচনায় বিষয়। আমাদের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে এই ধরনের কোন সামরিক চুক্তিতে যাওয়ার কোনো সুযোগ বাংলাদেশের নাই। এ বিষয়টিকে মাথায় রাখলে অবশ্যই আমাদের এই চুক্তিতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া ১৯৭২ সনের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের কারণেও আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন সামরিক জোটে যেতে পারি না।
তবে হঠাৎ করে চীনা কূটনীতিক উত্তেজিত ভাষায় যে মন্তব্যটা ছড়িয়ে দিলেন, তা আমাদের জন্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চীন আমাদের জাতীয় উন্নয়নে যতই সহযোগী শক্তি হোক না কেন যে কোনো সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার।
আমাদের দেশ এই মুহূর্তে বেশ কিছু মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সামাজিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত। দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর উইঘুর সম্প্রদায়ের ব্যাপারে এক ধরনের সহানুভূতি কাজ করে সেখানে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম প্রাধান্য পায়। চীনকে সেইজন্য এই জনগোষ্ঠীর আবেগের দিকেও নজর রাখতে হবে হঠাৎ করে কঠিন সুরে কথা বলে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করা উচিত না।
যথার্থভাবে উত্তর দিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। আশা করব সংবিধানের (২৫) অনুচ্ছেদ তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চীনের অবস্থানকে পর্যালোচনা করে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো সামরিক চুক্তিতে যাওয়া সঠিক নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বঙ্গবন্ধু হত্যা সব কিছুর সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। দীর্ঘকাল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে তারা পর্দার অন্তরালে কূটনীতিক ভূমিকা পালন করেছে, এ বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের জয়লাভের পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার নানান ষড়যন্ত্র করেছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক