ঢাকা: এ কোন শহর, এ কার শহর
এ কোন ঢাকা
ঢাকা মহানগরীর নানা দিক নিয়ে, নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বস্তুত সে আলোচনার সূত্রপাত অনেকে করেছেনও। আবার অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি, যেমন সাম্প্রতিককালে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী কলকাতা নগরীর আড্ডা নিয়ে সুন্দর একটি লেখা লিখেছেন। সেই লেখায় আড্ডার মধ্যে বাঙালীর আধুনিকতার সংকটের চেহারা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। বার্কলের অধ্যাপক দিলীপ বসু ও তাঁর সহকর্মীর কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন গুণ্ডা সর্দারের জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা 'মল্লবীর' নামে একটি পাণ্ডুলিপি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্যারী নগরীর পয়ঃব্যবস্থা নিয়ে সুন্দর ইতিহাস লেখা হয়েছে। এমনি অনেক আকর্ষণীয় বিষয় আছে যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এ বিষয়গুলি আমাদের আলোচনার বিষয় নয় কেন? এ সকল প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। তবে আমি এ প্রশ্নগুলি আজকের আলোচনায় তুলছি না।
অতীতের কোনো বিশেষ দিন ঢাকা শহর আমার চৈতন্যে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে ১৯৫৩ সালে ফরিদপুর শহরে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে সমবেত কণ্ঠে 'ও বাঙালী ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি' গানটি আমার ঘুম ভাঙিয়ে এক রক্তস্নাত শহরের ছবি হয়ে শিশুমনে গেঁথে থাকলো অনেক দিন। সে ছিল ঢাকা শহরকে নিয়ে এক ভয়াবহ স্মৃতি। এর আগের কিছু মনে করতে পারি না। আমার কল্পনার ভয়াবহ ঢাকা বদলে গেল অল্প কিছুদিন পরেই। এক অলস বিকেলে বায়োস্কোপের আকর্ষণে এক আনা দিয়ে চোখ লাগালাম আরো কয়েকজন সমবয়সীর সাথে। সুর করে নানা ছবির বর্ণনা দিতে দিতে হাতল ঘোরাচ্ছে বায়োস্কোপওয়ালা, আর নিমিষেই ছবিগুলি এসে যাচ্ছে চোখের সামনে। আজও মনে আছে এক বিশাল অট্টালিকার ছবি আসার সাথে সাথে বায়োস্কোপওয়ালার সুরেলা বর্ণনা, 'কি চমৎকার দেখা গেল, গনি মিয়ার বাড়ি আইল।' আর এত বড় বাড়ি যার সে না জানি কত বড়লোক! পরে জেনেছিলাম এই গনি মিয়াই ঢাকার নওয়াব আবদুল গনি। আর গনি মিয়ার বাড়িটাই আহসান মঞ্জিল। কার্জন হল, পুরানো হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ের ছবি দেখে ঢাকা আমার মাথায় স্থায়ীভাবে জেঁকে বসলো। পাখি যেমন একটা একটা করে খড়কুটো জোগাড় করে বাসা বাঁধে তেমনি ঢাকাও বাসা বাঁধতে লাগলো আমার চৈতন্যে।
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের আবেগে আপ্লুত কবি গোলাম মোস্তফার রচিত স্কুল পাঠ্য কবিতার মাধ্যমে বরিশালের বালাম চালের সঙ্গে ঢাকার গাওয়া ঘি বিশ্বের আকর্ষণীয় বস্তুর মধ্যে শীর্ষস্থানীয়, এ শিক্ষাও তদ্দিনে পেয়ে গেছি। '৫৪-র নির্বাচনে ফরিদপুর শহরে যুক্তফ্রন্টের প্রধান প্রচার কেন্দ্রটি ছিল আমার পৈতৃক বাসস্থানে। যেখান থেকে রোজ প্রচারিত হতো মুসলিম লীগ অপশাসনের নানা কাহিনী। তার মধ্যে অন্যতম ছিল নিউমার্কেট, শাহবাগ হোটেল, গুলিস্তান সিনেমা হল তৈরির অপরাধ। শাহবাগ হোটেলকে সাদ্দাদের 'বালাখানার' সাথে তুলনা করা হতো। তখন থেকেই ঢাকা দেখার এক তীব্র আকাক্ষা তাড়া করতে লাগল আমাকে। সুযোগটা এসে গেল ১৯৫৬ সালে। পিতার অভিভাবকত্বে ফরিদপুর থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যাক্সিতে রমনা রেস্ট হাউস-গুলিস্তান সিনেমা হলের পেছনে যার অবস্থান। ঢাকার দর্শনীয় স্থানের তালিকায় গুলিস্তান সিনেমা হল, বেবি আইসক্রিম, নিউমার্কেট, সদরঘাটের কামান, তারা মসজিদ, লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল ইত্যাদি সবই সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে সংগ্রহ করা। ইসলামপুরের অমৃত বস্ত্রালয়-সেই আলোকোজ্জ্বল বস্ত্রভাণ্ডার চোখ বুঁজলে এখনো আমি দেখতে পাই।
জগন্নাথ হলের যে ভবনটি ভেঙে পড়েছে, ওটাই ছিল তৎকালীন পূর্ব বাঙলার ব্যবস্থাপক পরিষদ ভবন। পিতার স্নেহাতিশয্যে সেই ভবনটিতে প্রবেশ করার সুযোগ জুটে গেল। পুরানো এয়ারপোর্ট আর ওদিকে নওয়াবপুর, পুরানা পল্টন, গেণ্ডারিয়া, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন আর নিউমার্কেট। গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। টাউন সার্ভিস, রিকশা আর কিছু ট্যাক্সি। অল্পকিছু ঢাকাইয়া বোলচালও রপ্ত করলাম। ফরিদপুর ফিরে রাতারাতি ঢাকা-বিশেষজ্ঞ হয়ে যাওয়ায় কিশোর সহপাঠী মহলে কদর অনেক বেড়ে গেল। ঢাকা নিয়ে অনেক গল্পই অতিরঞ্জিত হতে শুরু করলো। কৈশোরের সেই উচ্ছ্বাসপ্রসূত অতিরঞ্জনকে ভবিষ্যতের ঢাকা নিশ্চিতভাবে বহুগুণ অতিক্রম করে গেল তার অবয়ব, বহর আর সাজসজ্জায়।
পুরানো ঢাকা কেমন ছিল আজ থেকে একশ' বছর আগে? হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর বিবরণ রেখে গেছেন। উর্দুতে লেখা বইটির নাম ঢাকা পাচাশ্ বারস্ পহেলে। ১৯৪৫-এ লেখা। ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিমের অনুবাদ ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
"বর্তমান ঢাকার সীমানা এমন যে, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী, উত্তরে রমনার পর ময়মনসিংহের চৌরাস্তা, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার প্রাচীন ধারা এবং নূরপুর মহল্লা ইত্যাদি এবং পূর্বে আলমগঞ্জ, ফরিদাবাদ, গেণ্ডারিয়া অতিক্রম করে সম্মুখদিকে অর্থাৎ পূর্বদিকে সম্প্রসারিত। এই চতুঃসীমার মধ্যবর্তী জায়গায় অনেক উঁচু নিচু ধরনের জমি রয়েছে। নগরীর পশ্চিম অংশ এবং মধ্য শহরের পূর্বাংশ নিচু এবং কোথাও কোথাও পানিতে তলিয়ে যায়।
আগে শহরের মধ্যে একটি নালা বা খাল প্রবাহিত ছিল অর্থাৎ দোলাই খাল, যা দোলাই নদী বলা হতো। এটিই ঢাকার পূর্ব প্রান্তসীমা ছিল। এই খালের এক অংশ শহরের মধ্য এখনকার ইংলিশ রোড পর্যন্ত প্রবাহিত ছিল। এ পর্যন্ত এই খাল যথেষ্ট প্রশস্ত ছিল এবং প্রকৃতই নদীর মতো দেখা যেত। এরপর কোথাও চওড়া কোথাও সরু হয়ে বংশাল, নাজিরা বাজার, মিরনের জল্লা, সিককাটুলী, আমানাত খানের দেউড়ি হয়ে চাঁদ খানের পুলের নিচে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হোসেনী দালানের পূর্বে গিরদে কিল্লা ও চুরিহাট্টার পিছন দিক হয়ে রহমতগঞ্জের শেষে পশ্চিম সীমায় বুড়িগঙ্গায় পড়ত। কিন্তু এখন চাঁদখার পুলের পরে যে গমন পথ ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে এবং সেই খালের সব চিহ্নই লুপ্ত হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা এবং উক্ত খালের মধ্যবর্তী অঞ্চল পুরাতন শহর বা পাঠানদের ঢাকা।
মোগল ঢাকা, বেশির ভাগ পশ্চিমদিকে ক্রমান্বয়ে আবাদ হয়েছে। যে দিকে বন্যার ভয় ছিল না যদিও পূর্বদিকেও জনবসতির পরিসর বাড়তে থাকে যার চিহ্ন বাংলা বাজার মহল্লা। ইসলাম খান চিস্তি ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাকে রাজধানীর জন্য নির্বাচন করে সর্বপ্রথম একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা আজ 'আশেক জমাদার' গলিতে আবাদ অবস্থায় বর্তমান। এই মসজিদ এবং শাহজাদা সুজার তৈরি স্মৃতিচিহ্নসমূহ এই প্রাচীন শহরের মধ্যেই অবস্থিত। শায়েস্তা খানের সময়ে ঢাকা খুবই বিস্তৃত হয় এবং দোলাই খালের অপর পারে ফরিদাবাদ এবং আলমগঞ্জ নামে মহল্লা স্থাপিত হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে দোলাই নদীর পূর্বতীরে বসতি অনেক বৃদ্ধি পায়। সুতরাং নারায়ণদিয়া (নারিন্দা), কোম্পানিগঞ্জ ইত্যাদি বসতি স্থাপিত হয়। কিন্তু ওয়ারী, গেণ্ডারিয়া, শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, স্বামীবাগ, টিকাটুলী ইত্যাদি আমার দেখা সময়ে জনবসতিপূর্ণ হয়েছে। ঢাকার প্রচলিত কথা আছে, 'ঢাকার ৫২ গলি এবং ৫৩ বাজার'। আজও বাজারসমূহের এরূপই অবস্থা বহাল আছে। লালবাগ থেকে শুরু করে ফরিদাবাদ পর্যন্ত তিন মাইল দীর্ঘ রাস্তার দু'দিকে দোকানসমূহ রয়েছে এবং নবাবপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত অনুরূপ অবস্থা এবং প্রত্যেক রাস্তা ও সড়ক দোকানে পূর্ণ।"
২.
ঢাকার উন্নয়নের পরবর্তী জোয়ার আসে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর। ঢাকা আবার রাজধানী হলো। তৎকালীন লেখক ব্রাডলি-বার্টের কথায়: "কালজীর্ণ ধূসরিমায় আচ্ছন্ন ভবনাদির মাঝে চমকসৃষ্টিকারী লাল ইটের নবীনতা নিয়ে এক আধুনিক নগর গড়ে উঠছে।" এ সময়কার উল্লেখযোগ্য ইমারতসমূহের মধ্যে রয়েছে কার্জন হল, প্রকৌশল বিদ্যালয়, প্রকৌশল ছাত্রাবাস (বর্তমান ফজলুল হক হল), ঢাকা হল, লাটভবন (প্রথমে হাইকোর্ট ভবন ও পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দফতর), সচিবালয় ভবন (ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের একাংশ), ছাপাখানা ভবন (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ) ইত্যাদি।
বুদ্ধদেব বসু, কিরণশংকর সেনগুপ্ত আর শামসুর রাহমানের ঢাকা থেকে আমার কৈশোরের ঢাকা ততদিনে বেশ খানিকটা বদলেছে। বুদ্ধদেব বসু ১৯৩১ সালে লিখেছেন, "কী সুন্দর এই রমনা... "। তাদের বাড়িটি রমনার একেবারে শেষ সীমান্তে, এর পেছনে আর ভদ্রপল্লী নেই, পাকা সড়ক একটু এগিয়েই শেষ হয়ে গেছে, তারপর একটা শুকনো খাল এবং সেই খালের ওপারই খাঁটি পাড়াগাঁ আরম্ভ হলো (বস্তি নয় ভাগ্যিস!) মগের মুল্লুক- না, না, "মগবাজার।" কিরণশংকর সেনগুপ্ত চল্লিশ দশকের ঢাকার এই মগবাজার অঞ্চল নিয়ে লিখেছেন। "এলাকাটি ছিল পল্লীগ্রামেরই অংশ, পুরনো ঢাকা অঞ্চল থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে।" "প্রথম যখন ওখানে ভদ্রলোকদের বসবাস শুরু হয়, তখন মাত্র সাত-আটটি বাড়ি তৈরি হয়েছিল।" শামসুর রাহমানের জন্মের সময় (১৯২৯) ঢাকার চেহারা কেমন ছিল? "এ শহরে একটা সরু গলিতে যখন আমি প্রথম চোখ খুলেছিলাম তখন ঢাকা ছিল কেমন ফাঁকা ফাঁকা। এত বড় দালান ছিল না, বাস ছিল না, মোটর ছিল না, এমনকি রিক্সাও ছিল না, রাস্তায় রাস্তায় ছিল না সারিসারি পিঁপড়ের মতো মানুষের ভিড়। ছিল ছোট ছোট পথ, একটি কি দু'টি বড় রাস্তা ছিল। ছিল অনেকগুলি গলি, সেসব চুলের ফিতের মতো গলির ভেতর ছিল জনমনিষির বসতি। পাড়ায় পাড়ায় ঘাস বিচালির গন্ধ ছড়ানো আস্তাবল ছিল, আর ছিল ঘোড়ার গাড়ি।"
কবির স্মৃতিতে ১৯৪৫-এর ঢাকা; "আমরা মাহুৎটুলী ছেড়ে শহর থেকে দূরে পল্লীপ্রতিম ইস্কাটনে চলে গেলাম। ...তখন ইস্কাটন শহরের এক নিভৃত কোণে; একটি কি দু'টি দালানের উপস্থিতি সত্ত্বে সেই এলাকায় ছিল গ্রামের আদল।" "পাড়া গাঁ তুল্য কাওরান বাজারের ছায়াচ্ছন্ন পথ, জলাময়, লেবুতলা, সারিসারি জামগাছ, বুনো ফল, আর দিঘির জন্য হঠাৎ কোনও দিন মন কেমন করে।" কবির ইচ্ছে হয় ছুটে যেতে সেখানে একা একা। কিন্তু কোন্ পথে তিনি যাবেন? "সে পথও হারিয়ে গেছে শাহরিক ভিড়ভাট্টায়। সেই দিঘিটি অনেক জলাশয়ের মতো সেটিও ভূমি চাপা পড়ে গেছে কোনও আলিসান বহুতল দালানের ভিত্তিপ্রস্তরের নিচে।" একালের ঢাকাবাসীর মন এতে ভারাক্রান্ত হয় কিনা আমি জানতে পারি না।
সুকুমার রায়ের স্মৃতিতে গেঁথে আছে, "বাড়ি থেকে বেরুলে চোখে পড়তো দূর-দূরান্তের নীলক্ষেতের সীমানা পর্যন্ত, একটু এগিয়ে গেলে গাছের ভেতর দিয়ে ধানমন্ডি পর্যন্ত চোখে আসতো। আর ধানমন্ডির দিক থেকেই না প্রচণ্ড কালবৈশাখী প্রতিবছর ছুটে আসতো।" এ তো ১৯২১ সালের পরের স্মৃতি। অতীত ঢাকার জন্য এই রোমান্টিকতা আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এঁরা কেউ গরিবরা কোথায় থাকত, কিভাবে থাকত তা লেখেননি, এঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ভদ্রপল্লীর সীমানার মধ্যে।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের পরে একটি নব্যস্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের আকাক্সক্ষা ও চাহিদার প্রতি সাড়া দিয়ে নগরীর সম্প্রসারণের ধারায় মতিঝিল ও দিলকুশাতে গড়ে উঠলো প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক ইমারতশ্রেণী। আজিমপুর, ঢাকেশ্বরী, শান্তিনগর, মতিঝিল, ধানমন্ডি ও ইস্কাটনে সরকারি কর্মচারীদের জন্যে আবাসনগুচ্ছ নির্মিত হলো, আর তেজগাঁওয়ে স্থাপিত হলো বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। নিউমার্কেট ও স্টেডিয়াম মার্কেট তৈরি হলো প্রধান বিপণিকেন্দ্ররূপে। ভারত থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্যে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে আবাসনগুচ্ছ গড়ে তোলা হলো।
এ কোন ঢাকা? কালের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা এগুচ্ছে। '৬৩ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র হয়ে আজ অবধি ঢাকার পরিবর্তন দেখছি। '৬৭-এর এক রাতে আমার এক বন্ধুর সাথে সারারাত ঢাকার রাস্তায় হেঁটেছিলাম। শখ হয়েছিল 'রাতের ঢাকা' দেখার। রাস্তায় মধ্যরাত্রির পরে লোকজন নেই, দু'একটি দোকান খোলা। রাত্রির শেষ ভাগে একটা চায়ের দোকানের খোঁজে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। স্টেশন তখনো চালু হয়নি। নবনির্মিত মতিঝিল স্টেশনে সূর্যোদয় দেখে ফিরে এসেছিলাম। এখন সকালের সূর্য ঢাকা পড়েছে উঁচু অট্টালিকার আড়ালে।
প্রতিদিনই এ শহরকে অচেনা মনে হয়। পুরানো বাড়ি ভেঙে যাচ্ছে। ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে, বাড়ির আঙ্গিনার সব গাছ আর বাগান বিলুপ্ত হচ্ছে। হাইরাইজ বিল্ডিং, শপিংমল, ক্লিনিক, বিউটি পার্লার, হোটেল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তায় সোডিয়াম বাতি, রেলিং দেয়া ফুটপাত, ফ্লাইওভার, ডিভাইডারের ভাঙাগড়া, দ্রুত বদলে দিচ্ছে ঢাকাকে।
ঢাকার চোখে এখন ঘুম নামে না। মধ্যরাত্রি থেকে হাজার হাজার পোশাক শিল্পের মেয়েরা মিছিল করে শহরের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। সূর্য ওঠার আগেই মিছিল করে আবার ফিরে আসে শেষ রাতের নীরবতা ভেঙে। অসংখ্য ট্রাক, দূরপাল্লার রাতের বাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে বিভিন্ন শহর বন্দরের দিকে। তখন কাওরানবাজারে আর গুলশানের রাস্তায় টুকরিতে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমায় অজস্র ঠিকানাহীন ক্লান্ত নরনারী। গুলশানের আধা অন্ধকার, আধা আলোকিত সড়কে তরুণীরা খদ্দেরের আশায় এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে। এ নগরীতে এদের সংখ্যা ২৫ হাজার। পুরো সংখ্যাটি কি জানা সম্ভব? যে ভিখেরীদের সাথে প্রতিদিন আমাদের দেখা হয় তাদের কোনো সঠিক হিসেবও সরকারি দফতরগুলিতে নেই।
ঢাকা শহরের অগ্রগতির ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা '৪৭ থেকে ২০০৫-এর কাহিনী বলতে পারবেন। লোক সংখ্যা কত বাড়লো, কত বাড়ি তৈরি হলো, কত রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, হোটেল তৈরি হলো অর্থাৎ নগরায়নের এক ধরনের ইতিহাস। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমি এ ইতিহাস লেখায় খুবই অনভিজ্ঞ। পরিসংখ্যান আমার হৃদকম্প বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকার নতুন যাত্রা শুরু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে। সেদিনটির ঢাকার বর্ণনা তাজউদ্দিন আহমদের ডায়েরির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাজউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, "ঢাকা শহরের সকল মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার অধিবাসীরা সারা দিনরাত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য তোরণ নির্মাণ এবং সাজসজ্জা প্রভৃতির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল।" জনগণের আনন্দোল্লাসে মুখরিত ছিল পথঘাট। যখন রাত নেমে এলো এবং আনন্দোৎসব শেষ হলো তখনো ঢাকার রাজপথে বহুলোক রয়ে গেল। তাজউদ্দিন ১৫ আগস্ট লক্ষ্য করেন অধিকাংশ লোকই জেলার বাইরের গ্রামবাসী, তারা এসেছিল... 'পাকিস্তান' দেখতে। শুধুমাত্র মুক্তির অনুভূতিই তাদের টেনে এনেছিল ঢাকায়, নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রে।
-
লেখক: ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অনারারি শিক্ষক