তবে কি মানুষই এ জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস?
ব্রাজিলের রাজধানী রিও-ডি-জেনিরোর কাছাকাছি একটি দ্বীপে এক বুড়োর পোষা একটি পেঙ্গুইন ছিল। বুড়ো জোয়াও পেরিরার পেঙ্গুইনটির নাম ছিল ডিনজিম।
জোয়াও আর ডিনজিমের পরিচয় আজ থেকে ৬ বছর আগে। জোয়াও একদিন হঠাৎ দেখলো একটি ছোট পেঙ্গুইন সমুদ্রে তেলের মধ্যে আটকা পড়েছে। সে তাকে তুলে নিয়ে এসে গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে, নিজের কাছেই রেখে দিলো।
এর কয়েকদিন পর সে ডিনজিমকে সমুদ্রে ছেড়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর জোয়াও দেখলো তার উঠানে আবার ডিনজিম এসে হাজির। ডিনজিম প্রায় ১১ মাস তার বন্ধু হয়ে থেকে গেল।
এরপর ডিনজিম তার স্বজাতির কাছে উত্তরে চলে যায়, আবার প্রতি জুন মাসে জোয়াও পেরিরার কাছে ফিরে এসে দেখা করে যায়। কারণ পেঙ্গুইনটা বন্ধু জোয়াও এর কাছে কৃতজ্ঞ যে সে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
এই গল্পটা দিয়ে যখন লেখাটা শুরু করলাম, ঠিক তখুনি কেরালায় একটি গর্ভবতী হাতির বোমা ভরা আনারস খাওয়া ও তিনদিন পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে মারা যাওয়ার ঘটনাটি জেনে আর লিখতে পারছিলাম না। বুকটা ভেঙে গেল মা হাতিটার জন্য। মনে হলো- আমাকে আমার সন্তানসহ কেউ মেরে ফেলল।
পরে জানতে পেলাম কেরালা বন বিভাগ বলেছে যে, এই হাতিটিকে কেউ ইচ্ছে করে বোমাসহ আনারস খেতে দেয়নি। ঐ এলাকায় ফসলের ক্ষেতকে বন্য শুয়োরের হামলার হাত থেকে রক্ষার জন্য চাষিরা এরকম করে ডিনামাইট ভরে আনারস দিয়ে রাখে। হাতিটি পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে এরকম একটি আনারস খেয়ে ফেলেছিল। ক্ষেত রক্ষা করার জন্য এটি একটি ভয়াবহ পদ্ধতি।
এইভাবে এর আগে আরও বন্যপশু মারা যাওয়ায় এই নিয়মটি তুলে নেয়া হচ্ছে। ১৫ বছর বয়স্ক হাতিটির ময়নাতদন্তের পর জানা গেছে সে মা হতে যাচ্ছিল। যে ডাক্তার এই ময়নাতদন্ত করেছেন তিনি বলেছেন, "এর আগে এত কষ্ট আমি কখনো পাইনি। আমার হাতে একটি বাচ্চা, যাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না।"
এই ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নিউজ করেছে অনেক সংবাদমাধ্যম। তবে আমি অবাক হলাম এই দেখে যে ভারতের মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর সাথে সাথে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই হাতি হত্যার ঘটনার তদন্ত করবে এবং অপরাধীকে ধরবে। তিনি বলেন, এই ঘটনা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে যায় না।
কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও বলেছেন হাতিটির মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। টুইটারে পশুর বিরুদ্ধে এই জঘন্য আচরণের প্রতিবাদে একের পর স্কেচ, ছবি ও স্ট্যাটাস শেয়ার করছে অগণিত মানুষ।
ভারতের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী রতন টাটাও সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন, "আমি ভাবতেও পারছি না মানুষ এমন কাজ করতে পারে। এ ভয়ংকর। এটা ভয়ংকর ক্রিমিনাল কাজ। মানুষ খুন আর হাতি খুনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অবিলম্বে বিচার হোক।"
রাষ্ট্রের এই পর্যায় থেকে যখন বড় বড় মানুষ প্রাণী হত্যার বিচার দাবি করেন, তখন সত্যিই খুব ভালো লাগে। মনের মধ্যে একধরণের স্বস্তি আসে।
জোয়াও পেরিরা আর ডিনজিমের মতো মানুষে-পশুপাখিতে প্রায়ই বন্ধুত্ব হয়। আমাদের দেশেও অনেকে আছেন, যারা পশুপাখিকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
তবে এদেশে পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণই বেশি দেখেছি। ১৯৮৮ সালের বন্যায় খুলনা-যশোর এলাকায় একটি হরিণ পানির স্রোত থেকে বাঁচার জন্য একটি বাসায় আশ্রয় নিতে এসেছিল, বাসার লোকজন তাকে খেয়ে ফেলেছে।
নাটোরের একটি গ্রামে ঝড়ে প্রায় আড়াইশো শামুকখোল পাখি আহত হয়ে গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাদের রান্না করে খেয়ে ফেলেছে।
মাদারীপুরে একটি এলাকায় একদল বানর মানুষকে উৎপাত করছিল বলে, মানুষ রাগ হয়ে ১৫/১৬ টা বানরকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে।
খুব সম্প্রতি দেখলাম বগুড়ার একটি বাড়ির ছাদে বাসা বেঁধেছিল একটি গন্ধগোকুল। তার চারটি বাচ্চার জন্য সে খাবার আনতে গেলে কিছু দুষ্টু ছেলে বাচ্চাগুলোকে নিচে নামিয়ে আনে। মা এসে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে। তখন ছেলেগুলো মা গোকুলটিকে মেরে ফেলে। তবে বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করা গেছে।
সিলেটের জৈন্তাপুরের একটি গ্রামে ৬টি শেয়াল, দুইটি বাঘডাশ ও একটি বেজিকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় কিছু তরুণ। এই নিরীহ প্রাণীগুলো টিলার উপর একটি গর্তে থাকতো। এই অপরাধীদের বনবিভাগের ক্রাইম ইউনিট খুঁজছে। যদিও যারা মেরেছে, সামাজিক মাধ্যমে তাদের ছবিও আছে।
বাংলাদেশে যখন পশুপাখির প্রতি এরকম নির্দয় কোন আচরণ করা হয়, তখন আমি কখনো দেখিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়, ব্যবসায়ী মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, তারকা বা অন্য পেশাজীবিরা কেউ এ নিয়ে কোন উদ্বেগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং অপরাধীর বিচার দাবি করেছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তেমনভাবে বিচারেরও আশ্বাস দেয়া হয় না। এব্যাপারে আইন থাকলেও আমি কখনোই কাউকে শাস্তি পেতে দেখিনি।
গণমাধ্যমে সংবাদ হয়, সামাজিক মাধ্যমে সামান্য কিছু হৈচৈ হয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষকরা দু:খ প্রকাশ করেন, বনবিভাগ তৎপর হয় - ব্যস, তারপর সব শেষ। আমার খুব দু:খ হয় কেন পশুপাখি নিধন, বন-জঙ্গল লোপাট, নদী ভরাট এইসব ইস্যুকে খুব তুচ্ছ বা কোন অপরাধ বলেই গণ্য করা হয় না এদেশে।
প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ এরকম আচরণ কেন করে? কেন কোন কারণ ছাড়া পশুপাখিকে মেরে ফেলে?
আমি চোরা শিকারীদের কথা বলছি না। কারণ এরা ব্যবসার জন্য পশুপাখি হত্যা করে এবং বিশ্বব্যাপী এরা অপরাধী । কিন্তু সেই তরুণরা যারা টিলার উপরে আশ্রয় নেয়া পশুগুলোকে মারলো, যারা বন্যার সময় ঘরে আশ্রয় নেয়া হরিণটিকে খেয়ে ফেললো, যারা গন্ধগোকুল মাকে মেরে ফেলল, যারা কুকুরের হাত-পা ভেঙে দেয়, বিড়ালকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়, আহত শামুকখোল পাখিদের রান্না করে খেয়ে ফেলে, বিষ খাইয়ে মাছ, বানর ও পাখি মেরে ফেলে। এরা আসলে খুনি। আজকে পশুপাখি খুন করছে, কালকে মানুষ খুন করবে।
পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা একধরণের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। স্কুলে থাকতে একটা বইতে পড়েছিলাম, মানুষই এ জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস। কারণ একমাত্র মানুষই পারে অপ্রয়োজনে বা তুচ্ছ কারণে ভয়ংকরভাবে মানুষ ও পশুপাখিকে হত্যা করতে। আর কোন জীব তা পারে না। এমনকি খুব বিষধর সাপও হঠাৎ মানুষকে আক্রমণ করে না। একথাটা সেসময় শুধু পড়েছিলাম, যতো দিন যাচ্ছে মানুষের সেই কদর্য চেহারাটা ততো চোখে দেখতে পারছি।
বছর খানেক আগে আমি একজন বন্যপ্রাণী ও পাখি গবেষকের তোলা নিঝুম দ্বীপের একটি ছবি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। ছবিতে দেখলাম, একটি ডলফিনকে দুইটি বাঁশের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে করেছিলাম কোন কাল্পনিক ছবি। পরে জানতে পারলাম- না, এটা কোন কাল্পনিক দৃশ্য নয়, একেবারেই সত্যি।
সেই গবেষক জানালেন, এলাকাবাসী এই ডলফিনটিকে ধরে দুইটা বাঁশে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে, যেন ডলফিনটির শরীর থেকে তেল জমা হয় নিচে রাখা পাত্রে। আমার জীবনে এত কষ্টকর ছবি আর দেখিনি। জানতামও না এভাবে এই প্রাণীটিকে হত্যা করা হয়। অথচ এই নিঝুম দ্বীপকে ডলফিন ও শুশুকের জন্য অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বা সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার কথা। এরপরও সেই তেল সংগ্রহের জন্য ডলফিন ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস ডলফিনের তেল দিয়ে নারীদের রোগ সারানোর ওষুধ বানানো যায়। ভিত্তিহীন একটি ধারণার উপর বিশ্বাস করে একশ্রেণীর বর্বর মানুষ এই নৃশংস কাজটি চালিয়েই যাচ্ছে।
এই লকডাউনের সময়ে এসে সেই দুর্বৃত্তরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একটার পর একটা ডলফিন হত্যা করছে আর তেল বের করে নিয়ে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে।
হালদা নদীকে ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। হালদা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় নদী, যেটা পার্বত্য চট্টগ্রামের বদনাতলী পাহাড়ি রেঞ্জ থেকে শুরু হয়ে ৩টি উপজেলা হয়ে কর্ণফুলি নদীতে পড়েছে।
এই নদীতে ২০১৮ সালে যান্ত্রিক নৌযান চলাচলের বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও এই হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে শান্তিতে নেই ডলফিনগুলো। পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে ডলফিন আর মা মাছ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এই গাঙ্গেয় ডলফিনকে মহাবিপন্ন হিসাবে তালিকাবুক্ত করেছে ৮ বছর আগেই।
ডেইলি স্টার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লিখেছে, হালদা নদীতে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত করা এক জরিপে ৪৫ টি ডলফিনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। হালদা নদীর মোহনা থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যেন এই ডলফিন সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু এরমধ্যে মারা গেছে ২৪ টি ডলফিন। এইভাবে উজাড় হতে থাকলে ২০২২ নাগাদ নাকি সব ডলফিন নাই হয়ে যাবে।
কিভাবে এই ডলফিনগুলো মারা যাচ্ছে ? এদের কখনো ঝুলিয়ে রেখে মারা হচ্ছে, কখনো বা কুপিয়ে মারা হচ্ছে। কখনো বা এরা ইলেকট্রিক মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। তাছাড়া আছে শিল্পকারখানার দূষণ ও যান্ত্রিক নৌযান। এইসব ঠেকাতে মৎস্য বিভাগ ও বন ও পরিবেশ অধিদফতরের কঠিন ভূমিকা প্রত্যাশা করি।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, আমরা এভাবে প্রাণী হত্যা করতে পারি না। প্রাণী অধিকার রক্ষায় জনগণকে সবচেয়ে আগে সচেতন করতে হবে। আর এই কাজে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তারকাদের কাজে লাগাতে হবে। স্থানীয় মানুষকে বোঝাতে হবে কেন আমরা বন্যপ্রাণী শিকার করবো না। শুধু সুন্দর আর অসহায় বলে নয়। প্রাণীরাই মা প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। আর আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এই প্রকৃতি মাতার সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি।
৫ জুন, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন