ধর্ষকের ‘সাজা’ বিয়ে: তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ
জাতি হিসাবে তুর্কীদের ইতিহাস বেশ পুরনো। কয়েকশো বছর ইউরোপের কিছু অংশ ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত অটোম্যানরা। ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে বিশেষত সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য (অটোম্যান সাম্রাজ্য) দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, উত্তরে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা ও হর্ন অব আফ্রিকা জুড়ে, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলসহবিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্য ছিল।
সুদীর্ঘ ছয়শত বছরেরও বেশি ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে অটোম্যান সাম্রাজ্য। তবে ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং নানা বিষয়ে ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোম্যান সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি থেকে দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক; যাকে বলা হয় আধুনিক তুরষ্কের জনক।
কামাল আতাতুর্কের ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল, কারণ দেশটি তখন সম্পূর্ণভাবে সম্রাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিল। নানান কৌশলের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশটির রাজতন্ত্রকে বিদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন তুরস্কের সেই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় নেতা। তার ক্ষমতায়নের পরপরই প্রথম যে কাজটি তিনি করেছিলেন তা হল, আয়া সোফিয়াকে তিনি একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিলেন।
তুর্কি জাতির মতো অনন্য স্থাপনা আয়া সোফিয়ার ইতিহাসও বেশ পুরনো। এটির প্রথম তৈরিকাল নবী মুহাম্মদ (স.) এর জন্মের পূর্বে। তারপর এটি নানাভাবে পরিবর্তিত হয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ স্থাপনাটিকে একটি মসজিদে রূপান্তর করেছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। এরপর থেকেই দেশটিতে সুন্নি ধর্মাবলম্বীদের প্রভাব এবং সুন্নি মতবাদের সঙ্গে দেশটির প্রগতিশীল অংশের সংকট গভীর হয়। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। দেশটির একটি অংশ ইউরোপ মহাদেশের অপর অংশটি এশিয়ার দেশটির সঙ্গে। ইউরোপের সঙ্গে দীর্ঘকালের সম্পর্ক থাকায় মহাদেশটির নানান জায়গায় ব্যাপকহারে তুরস্কের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যে কারণে তুরস্কের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত হওয়া আপাতদৃষ্টিতে সোজা মনে। কিন্তু বিষয়টি অতটাও সোজা নয়। তুরস্কের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে ইউরোপের অনেক পার্থক্য রয়েছে, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ইত্যাদি। ইউরোপের দেশগুলো এই বিষয়গুলোতে সংস্কার আনার শর্ত জুড়ে দিয়েছিল তুরস্ককে। কিন্তু নারীর ধর্ষণের অভিযোগ থেকে কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রত্যাখ্যান করায় এরদোয়ান সরকার স্পষ্ট করে তখন জানিয়ে দিয়েছিল বিষয়টির মধ্যে ইউরোপের মাথা ঘামানো উচিত হবে না।
তুরস্কে সংস্কার না হওয়া আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্ষণ সম্পর্কিত আইন। দীর্ঘদিন যাবত তুরস্কের নারীরা এই আইনের সংস্কার চাচ্ছিলেন। এই আইন একজন ধর্ষককে তার ধর্ষণের সাজা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। আইনে বলা হয়েছে, প্রথমবারের মতন যদি কেউ ধর্ষণ করে এবং সে যদি ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হবে না।
এমনি একটি অবস্থা সম্ভবত আমাদের দেশেও বিরাজমান। ১৮ বছর বয়সের নিচের নারীদেরকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই নারীরা যদি স্বেচ্ছায়ও কোনো যৌন সম্পর্ক অংশ নেয় তবে তা আইনের চোখে অবৈধ এবং তাকে ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের বেশ কয়েকটি ধর্ষণের বিচার আমরা দেখেছি যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে করতে চাওয়ার ভেতর থেকে ধর্ষককে জামিনে মুক্তি দিয়ে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমন খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় তৈরি হয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সিভিল সোসাইটির অনেক মানুষ ও তার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু ঘটনার গভীরে জানা যায় যে, সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পরেও পুরুষটি কেবলমাত্র চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে বিবাহ অস্বীকার জানানোর কারণে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে কীভাবে দেখা উচিত তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। পারস্পরিক সম্মতিতে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে তা কতটা যুক্তিসঙ্গত কিংবা যুক্তিযুক্ত? একদিকে যেমন সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল করতে হবে, অন্যদিকে নারীর অধিকারকে পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপন করতে হবে। এই ধর্ষকরা যেন আইনের শাসন থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে সেদিকে দেখতে হবে। ধর্ষককে বিয়ের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া কি সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে কিনা সেটি পরবর্তী প্রশ্ন।
তুরস্কের যে নারীরা ধর্ষণ নিয়ে এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তারাও কিন্তু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন খানিকটা বাংলাদেশের মতন, যে ১৮ বছরের নিচের নারীদের স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পরে তা ধর্ষণ হিসাবে অভিযুক্ত হয় কিভাবে? তাহলে তাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? এই আইন নিয়ে যে উদ্যোগ তুরস্কের ক্ষমতাসীন সরকার নিয়েছে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সোমবার তা দেশটির পার্লামেন্টে গৃহীত হবে। এটি ধর্ষকের মুক্তিলাভের আইন যা বিবাহের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে। প্রকারান্তে ইউরোপের দেশগুলোতে ধর্ষণের কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতার কোন অভিযোগ যে কোনো কালেই আনা করা হোক না কেন, তার বিচার হবেই। তুরস্কের পার্লামেন্টে এই আইন গৃহীত হলে বর্তমানের কারাগারে আটক প্রায় ৩ হাজার পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবে। তবে তাদেরকে ধর্ষিত নারীকে বিয়ে করতে হবে।
বিয়ে কেবলমাত্র শারীরিক সম্পর্ক নয়, পরস্পরের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতাও বটে। এমন একটি পরিস্থিতিতে ধর্ষণের পর বিবাহ দ্বারা নিষ্পত্তি হওয়া দাম্পত্য জীবন এবং তার পরবর্তীকালের সন্তানদের অবস্থা কোথায় দাঁড়াবে তা এখনি বুঝা যাচ্ছে না। কারণ পৃথিবীর অতীত ইতিহাস ধর্ষিতা নারীকে বিয়ে করার ভেতর থেকে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়া বিধান ছিল না। আমাদের দেশে বহুদিন যাবত অলিখিতভাবে সমঝোতার বিবাহ প্রচলিত আছে। তার পরিণতি আমরা সমাজে খুব একটা দেখতে পাইনা। কারণ এই ধরনের বিবাহ পর্দার অন্তরালে থেকে যায়। আপন কিংবা ধর্ষকের সামাজিক অবস্থান এ ক্ষেত্রে হয়তো প্রাধান্য পায়। আইনজীবী নিয়োগ করার সক্ষমতা, উচ্চ আদালতে আইনজীবীর দ্বারা মামলা পরিচালনা করা সামাজিক অবস্থানের পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে হয়তো আমাদের দেশেও এই ধারা স্থায়ী হবে। যদিও আমাদের দেশে কোন আইন ছাড়াই আদালত তার ক্ষমতাবলে এই ধরনের নিষ্পত্তি করছেন বলে জানা যায়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিম্ন আদালত থেকে ওই নিষ্পত্তি সৃষ্টি হয়েছে সুতরাং এটি যদি সমস্যার সমাধান হয় তাহলে তুরস্কের মতন আইন কেন আমরা প্রণয়ন করছি না, যা সমাজের সকল স্তরে আলাপ-আলোচনার ভেতর থেকে গৃহীত হবে। তুরস্কে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নাই যা আমাদের দেশে সম্প্রতিককালে করা হয়েছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক