নতুন বছরে আশাবাদী হওয়ার যত কারণ
চলছে বৈশ্বিক মহামারি (প্যানডেমিক)। এর সঙ্গে স্প্যানিশ ফ্লুর এক ধরনের মিল রয়েছে। কেউ যদি ১৯১৮ সালের সেই বিধ্বংসী ভাইরাস প্রকোপকে মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেন, তাহলে ২০২১ সাল কেমন যাবে- সে ভাবনা তার জন্য খুব একটা স্বস্তির হবে না। কেননা, শতবর্ষ আগে শুরু হওয়া ওই ফ্লুর প্রভাব দীর্ঘ তিন বছর ধরে পড়েছিল।
সেই ফ্লু প্যানডেমিকের মাত্র দুই দশকের ব্যবধানেই অর্থনৈতিক মহামন্দা (গ্রেট ইকোনোমিক ডিপ্রেশন) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আবারও সারা দুনিয়াকে ঝাঁকুনি দেয় এবং অগুণতি মানুষের মৃত্যু ও অকথিত অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে।
তবে এবারের বেলায়, মারাত্মক এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াই থেকে শুরু করে বেশ ভালোকিছু ব্যাপার রয়েছে; যার ফলে নতুন বছর ও আগামী বছরগুলো নিয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠা যায়।
প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো মারাত্মক কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি কার্যকর বর্ম হিসেবে ভ্যাকসিনগুলোর ডেভেলপমেন্ট। আধুনিক প্রযুক্তি একটি অকল্পনীয় গতিতে সেই মাইলফলক অর্জনে সাহায্য করছে বিজ্ঞানীদের।
ইতোমধ্যেই অন্তত চারটি ভ্যাকসিন অনুমোদনের পর ব্যবহার শুরু হয়েছে; অন্যদিকে, ডেভেলপমেন্ট চলছে আরও কয়েক ডজনের। বৃহৎ পরিসরে টিকাদান শুরু হবে নতুন বছর। মানব ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য, যা কি না কোভিড-১৯-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারের আশা জাগাচ্ছে।
স্প্যানিশ ফ্লুর বিরুদ্ধে লড়াই করা মানুষগুলোর ভাগ্য এত ভালো ছিল না। ফ্লু ভাইরাসকে হারানোর মতো কোনো ভ্যাকসিন করা যায়নি উদ্ভাবন।
তাছাড়া, ফ্লু ভাইরাস এমনই এক সময়ে দুনিয়ায় আঘাত হেনেছিল, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লাখেরও বেশি মানুষ হারিয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা রীতিমতো বিধ্বস্ত।
পরের দুটি দশকে দুনিয়া আরও দুটি মহাবিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছিল: প্রথমে অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপ্রান্যাশনাল ইউনিয়ন- ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্মের কারণে গত সাত দশক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি প্রশমন করতে সক্ষম হয়েছে পৃথিবী। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় এখন আর অতটা প্রবল নয়।
এবার দুনিয়া যেভাবে ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে প্রশাসনিক দক্ষতা দেখিয়েছে, ১৯১৮ সালের পৃথিবীতে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় সেটি সম্ভব হয়নি; কেননা, সেই সময়কাল ছিল ২০২০-এর পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম বিশ্বায়িত।
আধুনিক প্রযুক্তি ও চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে ২০২০ সালের পৃথিবী অনেক বেশি পরস্পর সংযুক্ত ও সুসজ্জিত; ফলে স্প্যানিশ ফ্লুর চেয়ে কোভিড-১৯-এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে অনেক কম।
ফ্লু প্যানডেমিকে আনুমানিক ৪ কোটি বা বিশ্ব জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। অন্যদিকে, এ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ প্রাণ গেছে ১৭ লাখ ২০ হাজার জনের; যা বিশ্ব জনসংখ্যার ০.০২২ শতাংশ।
শতবর্ষ আগে দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোর মানুষেরা ছিল অসহায়। স্প্যানিশ ফ্লু তাদের ওপরই সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত হেনেছিল; প্রাণ কেড়েছিল প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখের; পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের চেয়ে এই মৃত্যুহার ছিল সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলের মানুষ আরেকটি বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছিল- তেতাল্লিশের মন্বন্তর। ১৯৪৩ সালের ওই দুর্ভিক্ষে প্রাণ গিয়েছিল ৩০ লাখ জনের।
এবার পরিস্থিতি অতটা আতঙ্কজনক নয়।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য এশিয়ান দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার প্রবল শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিকারী ইউরোপিয়ান দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম।
হতদরিদ্র স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মধ্যেও দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোতে মৃত্যুহার কম হওয়ার বিষয়টি এখনো একটি প্যারাডক্স হয়ে রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলো ক্ষুধার হার একটি বড় মাত্রায় কমাতে সক্ষম হয়েছে। 'আনসাং হিরো' কৃষকেরা প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছেন, যেন আরেকটি মন্বান্তর বা দুর্ভিক্ষ চোখ রাঙাতে না পারে।
আশাবাদী হওয়ার আরও বেশ কিছু জোরাল কারণ রয়েছে।
ভাইরাসটির বিরুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়ে বেশ ভালোভাবে লড়তে পেরেছে এশিয়া। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের মতো কয়েকটি এশিয়ান দেশের গ্রহণ করা প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো অন্যদের জন্য হয়ে উঠেছে দারুণ উদাহরণ।
সেই কথা উঠে এসেছে ব্লুমবার্গ হেলথ-এফিসিয়েন্সি ইনডেক্সেও। সেখানে বলা হয়েছে, প্যানডেমিক বিধ্বস্ত পৃথিবীতে হংকং ও সিঙ্গাপুরের নেতৃত্বে এশিয়ান অর্থনীতি সবচেয়ে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাগুলোর র্যাংকিংয়ে শীর্ষে রয়েছে।
২০১৩ সালে প্রথম প্রকাশিত এই ইনডেক্সে মানুষের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল এবং চিকিৎসাব্যয় বিবেচনা করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ফলাফল যাচাইয়ের প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ বছরের সংস্করণে মৃত্যু এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির ৫৭টি দেশের দেশীয় পণ্যের ওপর কোভিড-১৯-এর প্রভাবকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
এইসব পরিমাপ বহু এশিয়ান অঞ্চলকে করোনাভাইরাস আক্রমণের জবাবে আক্রান্ত ও মৃতের হার তুলনামূলক কম রাখার ক্ষেত্রে নিজেদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করেছে। যেখানে কোভিড-১৯-এ প্রবল মৃত্যুহার ও দুর্বলতর অর্থনৈতিক অবস্থা সহকারে মানুষের আয়ুষ্কাল তুলনামূলক কমে আসা- তালিকার এমন তলানিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে জায়গা করে নিয়েছে ব্রাজিল ও রাশিয়া, বলছে ব্লুমবার্গ।
কয়েকমাস আগে এই অবয়ব ছিল তমসাচ্ছন্ন।
যখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে ভাইরাসটি তাণ্ডব তালাচ্ছিল, এর দাপট এড়ানোর প্রত্যাশায় দেশগুলো একে একে বন্ধ করে দিয়েছিল নিজেদের সীমান্তগুলো, জারি করেছিল অভূতপূর্ব লকডাউন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক থিংক-ট্যাংক তখন বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি হিমশীতল ভবিষ্যতের দিয়েছিল পূর্বাভাস।
ভাইরাসটি মোকাবেলায় এখনো ভুগছে আমেরিকা ও ইউরোপ, অথচ এমন সময়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য এশিয়ার অর্থনৈতিক অবয়বকে করে তুলেছে উজ্জ্বলতর।
২০২০ সালের চতুর্থ এক-চতুর্থাংশে এশিয়ান ফার্মগুলো সবচেয়ে বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে; কেননা, এ অঞ্চলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম হয়ে উঠেছে চাঙা- সাম্প্রতিক এক থমসন রয়টার্স/ইনসিড জরিপে এমনটাই দেখা গেছে।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির দেশের তুলনায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ও গ্লোবাল গ্রোথ ইঞ্জিন চীন দ্রুততার সঙ্গে পুনরুদ্ধার ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে তুলছে।
প্রসিদ্ধ এশিয়ান পণ্ডিত, কিশোর মাহবুবানি বলেন, '...ইতিহাস কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্য আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে। বিশ্ব পরিমণ্ডল ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এশিয়ার পুনরুত্থান- যা কিনা কোভিড-১৯ আবির্ভাবের আগেই ঘটেছিল, সেটি এই সংকটের পর একটি নতুন পৃথিবী গড়ায় রাখবে দৃঢ় ভূমিকা।'
বাংলাদেশের অবয়বও এখন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
গত অর্থবছরে এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৫ শতাংশ, যেখানে অনেক দেশের অর্থনীতিই পেয়েছে বিপরীত অভিজ্ঞতা। এই প্রবণতা নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। কেননা, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, শক্তিশালী উৎপাদনখাত ও রপ্তানির ওপর ভিত্তি ২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বেশ জোরালভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি ৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটাবে।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে এশিয়ার পুনরুত্থানে ঢাকার গুরুত্ব সামনের বছরগুলোতে আরও বাড়বে, এমন আশাবাদ জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেন, এশিয়া ও এশিয়ার বাইরে মার্কেট ও সাপ্লাই চেইন সংহত করতে বাংলাদেশের কৌশল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সরকারের উচিত টিকাদান নিয়ে অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক ধীরগতির মতো বাধাগুলো সরানোতে মনোযোগ দেওয়া। কোভিড যে আচমকাই উধাও হবে না, তার সব লক্ষণই বিদ্যমান। নতুন বছরেও আমাদের নিশ্চিতভাবেই এই ভাইরাসের সঙ্গে বসবাস করতে হবে। তাই প্রশাসনিক দক্ষতা আরও শক্তিশালী করে তোলা, এবং নিঃসন্দেহে একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনঃঅবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যে কোনো বাধা উৎরে আসার মতো দক্ষ স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরার বিষয়টি ২০২১ সালের শুরুতে, যত দ্রুত সম্ভব নিশ্চিত করা জরুরি।
শেষ কথা হলো, প্যানডেমিকের সময়ে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়কে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে ইতিবাচক খবর হিসেবেই ধরা যায়, এবং এ ঘটনা নতুন বছরে একটি নতুন দুনিয়াকে ভালোভাবে গড়ে তুলতে অবদান রাখবে বলে মনে হয়।
একটি ব্যাপার নিশ্চিত, ভয়ানক ২০২০-এর তুলনায় ভালো কিছুরই সম্ভাবনা দেখাবে ২০২১। তাছাড়া, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো যেসব উন্নত দেশে করোনাভাইরাস এখনো তাণ্ডব চালাচ্ছে, সেসব দেশের চেয়ে বেশ ভালো অবস্থানেই নতুন বছরটি শুরু করতে যাচ্ছি আমরা।
তাই চলুন সব প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে আশাবাদের কণ্ঠ ছাড়া যাক।
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
- মূল লেখা: Reasons to be optimistic