পঞ্জি স্কিমের অগ্রদূত হয়েও বহাল তবিয়তে ইভ্যালি
একটা ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই—ইভ্যালি একটা পঞ্জি স্কিম। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ই-কমার্স কেলেঙ্কারির অগ্রদূত এই প্রতিষ্ঠান। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইভ্যালির কারণে মানুষ অনলাইন মার্কেট প্ল্যাটফর্মের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
অর্থনীতির রীতিনীতিকে কাঁচকলা দেখিয়ে লোভনীয়, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অফার দিয়ে মানুষকে কীভাবে প্রলুব্ধ করতে হয়, সেই পথ দেখিয়ে দিয়েছে ইভ্যালি। সেইসঙ্গে ইভেন্ট স্পন্সর করা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে দেদারসে টাকা খরচ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টার কারণে ইভ্যালির কেলেঙ্কারি যখন প্রকাশ্যে এল, তখনই তারা নতুন ছলচাতুরির আশ্রয় নিল। প্রতিষ্ঠানটি তখন দাবি করে বসল যে, বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী যমুনা গ্রুপ ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করছে—যদিও এ দাবি কেউ বিশ্বাস করেনি।
এই দাবি কেন করেছিলেন ইভ্যালির মালিক মোহাম্মদ রাসেল? উত্তরটা সহজ। অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেও পণ্য না পাওয়া হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ গ্রাহকের টাকা কীভাবে ফেরতে দেবে, তা জানাতে ইভ্যালিকে সময় বেঁধে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেজন্যই তার বিরুদ্ধে আসন্ন পদক্ষেপ ঠেকাতে যমুনার নাম ব্যবহার করেছেন মোহাম্মদ রাসেল। এবং সে কাজে তিনি সফল।
মঙ্গলবার যমুনা সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করা করছে না। এরপর কী? ইভ্যালি এখন স্বভাবমতো দাবি করবে যে তারা বিদেশি বিনিয়োগকারী পাচ্ছে। এমন অসার দাবি কেবল বোকারাই বিশ্বাস করবে। সে যা-ই হোক, ইভ্যালি-সংক্রান্ত যেকোনো খবরের মন্তব্যের ঘরে চোখ বোলালেই বোঝা যায়, মানুষ এখন আর এই পঞ্জিকে বিশ্বাস করছে না।
ইভ্যালির দেনার পরিমাণ বিশাল। যদিও প্রতিষ্ঠানটি যে পরিমাণ দেনা দেখাচ্ছে, তা স্বাধীনভাবে অডিট করা হয়নি।
পেমেন্ট নেওয়ার কয়েক মাস পরও গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। যে পঞ্জি স্কিমের ওপর নির্ভর করে ইভ্যালি ফুলে-ফেঁপে উঠছিল, তা আর কাজ করছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া সর্বশেষ ব্যাখ্যায় মার্চেন্টদের ২০৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে কত সময় লাগবে, তা জানাতে পারেননি ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল।
যা-ই হোক, গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আয়োজিত ইভ্যালি ক্রেতাদের কয়েকটি গ্রুপের অ্যাডমিনদের সঙ্গে আয়োজিত এক বৈঠকে রাসেল বলেছিলেন তিনি নতুন বিনিয়োগকারী পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ক্রেতাদের তিনি বলেন, 'নতুন বিনিয়োগ ছাড়া পুরনো অর্ডার ক্লিয়ার করা সম্ভব নয়।'
হাজার হাজার গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দেনা ৩১১ কোটি টাকা।
দেনায় ও বদনামে ডুবতে থাকা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালিতে কে বিনিয়োগ করবে?
এত কিছুর পরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আরও দুই পঞ্জি স্কিম ইঅরেঞ্জ ও ধামাকার মতো রাসেলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
ধামাকা ও এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের এক ডজনেরও বেশি অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটির মালিকদের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়ায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পেমেন্ট নেওয়ার পর পণ্য সরবরাহ না করায় গ্রাহকদের দায়ের করা মামলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইঅরেঞ্জের তিন শীর্ষ কর্মকর্তা এখন কারাগারে আছেন। প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক, পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করায় তাকে আটক করেছে বিএসএফ।
গত মাসে অনিয়মের অভিযোগে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ইঅরেঞ্জ ও আরও তিন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করেছে।
ইভ্যালিকে গত জুলাইয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ই-ক্যাব। কিন্তু গত কয়েক মাসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ইভ্যালির বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগের পাহাড় জমা হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটির সদস্যপদ স্থগিত করা হয়নি।
একই অপরাধে লিপ্ত হওয়ার জন্য অন্যদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ইভ্যালির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়নি। এ কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠে গেছে, বিতর্কিত প্ল্যাটফর্মটি এখনও কোনো মহলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আছে কি না।
- লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: A pioneer in Ponzi scheme, Evaly still basks in blessings