ফেরিগুলো কেন বারবার সেতুর পিলারে আঘাত করছে?
অনেকদিন আগের কথা। বাংলাদেশ ফুটবল তথা ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের অবস্থা তখন ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের মতো। বাৎসরিক বিরাট অংকের টাকা নেওয়া ফুটবলাররা রয়েছেন, তবে খেলার মান প্রতিনিয়ত নিম্নমুখী। তখন পর্যন্ত ফুটবলাররাই ছিলেন খেলাধুলা জগতের সুপারস্টার। কিন্তু, তাদের মাঠের পারফরম্যান্স ছিল নিম্নগামী।
ঢাকা লীগের খেলা চলছে। একজন সুপারস্টার বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, উন্মুক্ত গোল পোস্ট। গোল কিপার অনেক সামনে এগিয়ে রয়েছেন। গোল লাইন আর মাত্র পাঁচ মিটার দূরে, সজোরে শট নিলেন তিনি; বল গোলবারের ওপর দিয়ে বাইরে চলে গেল। যদি মেসি বা রোনালদোকে ১০ বার এরকম পজিশন থেকে বল বাইরে পাঠাতে বলা হয়, প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হবে।
এমন একটি খেলার পর একজন ক্রীড়া সাংবাদিকের রিপোর্টের একটি লাইন ছিল এপিক, যা আমি কখনোই ভুলিনি। "জ্যামিতিক সমস্ত নিয়ম ভুল প্রমাণিত করে ছোট ডিবক্সের ভেতর থেকে তিনি বলটি পোস্টের বাইরে পাঠাতে সক্ষম হলেন"- হুবহু কথাটি মনে নেই, তবে মোটামুটি এমনই ছিল লাইনটি।
ফুটবল নিয়ে কিছু লেখার উদ্দেশ্য বা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। আমার লেখার বিষয় পদ্মা সেতুর পিলারের সঙ্গে ফেরির সংঘর্ষ।
গত চার বছর যাবৎ আমেরিকান দক্ষিণ উপকূলের বন্দরগুলোতে ঘনঘন যাওয়া-আসা করি। হিউস্টন এবং করপাস ক্রিস্টিতেই বেশি যাওয়া হয়, কারণ আমার জাহাজটি অন্যান্য বন্দরের তুলনায় আকারে একটু বড়। জাহাজটি ২৭৫ মিটার লম্বা, ৫০ মিটার প্রশস্ত এবং পণ্য ভরা অবস্থায় ওজন পৌনে দুই লাখ টনের কাছাকাছি।
সহজে বোঝার জন্য বলা যায়, চিটাগং বন্দরে সাধারণত ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ ঢুকতে পারে, তার চেয়ে আমাদের সক্ষমতা চার-পাঁচ গুণ বেশি। করপাস ক্রিস্টি এবং হিউস্টনের একদম অভ্যন্তরে পৌঁছানো সবচেয়ে বড় জাহাজ আমরাই।
হিউস্টন কিংবা করপাস ক্রিস্টির একদম ভেতর পর্যন্ত যেতে বেশ কয়েকটা ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়া লাগে। যেখানে দুয়েকটা ক্ষেত্রে মাত্র ১২০ মিটার চওড়া জায়গা দিয়ে ৫০ মিটার চওড়া একটি জাহাজকে পার করা হয়।গ্রীসের করিয়েনথাস খাল মাত্র ৩৫ মিটার চওড়া, সেখান দিয়ে ২৫ মিটার চওড়া জাহাজও পার হয়েছে।
কিন্তু সেই জ্যামিতিক সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে পাঁচ মিটার দূর থেকে গোল বারের ওপর দিয়ে বল পাঠানোর মতোই পদ্মা সেতুর দুই পিলারের মাঝের ১৫০ মিটার জায়গা দিয়ে ১০-১৫ মিটার চওড়া ফেরি যাবার সময় পিলারে গিয়ে আঘাত করে।
এটি কোনো ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা। মানে অস্বাভাবিক একটি ঘটনা। কিন্তু এরকম একটি দুর্ঘটনাই এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
যে কোনো দুর্ঘটনারই একটি তদন্ত করা হয়। আমাদের দেশে কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘঠিত হবার পর দায়িত্বশীল মহল থেকে ঘোষণা করা হয়, "তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, এবং দ্রুত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে"। এটাই হলো আমাদের প্রথম ভুল। তদন্তের প্রধান কারণ দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত করা নয় বরং এর প্রধান কারণ এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা।
অথচ, আমরা শুধু দায়ী ব্যক্তি খুঁজে বের করে তাকে বরখাস্ত বা বদলি করি। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কিন্তু, এক সপ্তাহ পর আবারও একই ঘটনা ঘটে। কারণ কখনোই মূল কারণ বা 'রুট কজ' খুঁজে বের করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
দুর্ঘটনা তদন্তের প্রথম শর্ত অভিজ্ঞ তদন্তকারী নিয়োগ দেয়া। আমাদের দেশে সবচেয়ে অগ্রগণ্য তদন্তকারী হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কিংবা বুয়েট। একজন বিচারপতি নির্ভীক, স্বাধীন এবং সৎ। কিন্তু তদন্তকারী হিসেবে প্রথম বিবেচনা করা উচিত তার পেশাগত দক্ষতা।
পায়রা বন্দরের নাব্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা নিয়োগ করি বুয়েটকে। কোনো সন্দেহ নেই বুয়েটে রয়েছে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক এবং গবেষকরা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের কি কোনো বন্দর নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে? অভিজ্ঞতা না থাকুক, এরকম বিষয়ে তারা কি কখনও কো্নো গবেষণা পত্র তৈরি করেছে?
তদন্ত প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় সমস্যা হলো 'সদিচ্ছা'। তদন্তকারী কি আসল সমস্যাটি তুলে ধরবে?
উদাহরণ স্বরূপ, কোনো এলাকায় একটি সংগঠনের কর্মীদের ওপর আনা অভিযোগের তদন্ত ভার যদি সংগঠনের নেতাকেই দেওয়া হয় কিংবা একটি সংস্থায় সংগঠিত কোনো অনিয়মের তদন্তভার যদি সংস্থারই কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাতে দেওয়া হয়, তবে তদন্তে আসল কারণ বেরিয়ে না আসার সম্ভাবনা থাকবে। আসলেও হয়তোবা ভাবমূর্তি রক্ষার্থে ধামাচাপা দেওয়া হবে।
অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণই নীতিমালার ব্যর্থতা। অতএব নীতিনির্ধারকরা সর্বদা তা গোপন রাখার চেষ্টা করেন। দ্রুততার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তদন্তের সমাপ্তি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।
অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন একটি আর্ট। কিছু অভিজ্ঞ পেশাদার রয়েছেন, তাদের কাজই হল আসল কারণ খুঁজে বের করা। যেমন, একজন ইন্সপেক্টর পদের পুলিশ অফিসারও চৌকশ তদন্তকারী হতে পারে। সে একজন বিচারক কিংবা বুয়েট গবেষকদের চেয়ে দ্রুত এবং নিখুঁত ভাবে আসল ঘটনা চিত্রায়িত করতে পারবে।
অতঃপর ঘটনাটি দেওয়া হবে বিশেষজ্ঞদের কাছে, যারা রুট কজ অ্যানালাইসিস করবেন। অতপর আরেক দল নির্ধারণ করবে কি কি পদক্ষেপ নিলে তার পুনরাবৃত্তি রোধ করা য়ায়। কিন্তু আমাদের দেশে এক সদস্য বিশিষ্ঠ তদন্ত কমিটি নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি যেখানে তদন্তকারীর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই থাকে না।
বিশ্বে যেকোনো অঞ্চলে কোনো নৌ দুর্ঘটনা ঘটলে, শুধু সে দেশে নয়, বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে 'অ্যাকসিডেন্ট রিপোর্ট' পাঠানো হয়। সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কেইস স্টাডি করে, এরপর পরস্পরের রিপোর্ট দেখে তুলনা করা হয়। এভাবেই বের করা হয় মূল কারণ। অতঃপর রুট কজ অ্যানালাইসিস করে তার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে কয়েকটি ফেরি পদ্মা সেতুর পিলারে আঘাত করেছে। কয়েকজন বরখাস্ত হয়েছেন কিংবা সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা আবারও ঘটছে, কেননা আসল কারণ নির্ধারণ করা হয়নি। তা রুখে দেবার পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো এমন কিছু বক্তব্য দেওয়া হয়, যা দুর্ঘটনাকে উৎসাহিত করে। যেমন, চার হাজার টনের জাহাজ ধাক্কা লাগলেও কিছু হবে না। কিন্তু নেভিগেশনে কোনো জাহাজ কোনো বয়ার সাথে একটু ঘষা খেলেও কোটি টাকা জরিমানা হয়ে যায়। বয়ার কোনো ক্ষতি না হলেও এই জরিমানা দিতে হয়।
উন্নত বিশ্বে একটি জাহাজ যদি ব্রিজের নিচ দিয়ে যাবার সময় শুধু পিলার স্পর্শ করে, ক্যাপটেনের চাকরি যাবার পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে কোম্পানিকে কয়েক কোটি টাকা দিতে হয়। এটা ক্ষতিপূরণ নয়, ঝুঁকিপূর্ণ ন্যাভিগেশনের জন্য জরিমানা।
আমাদের দেশে সবকিছুই 'আমরা আমরাই তো', তাই কোনো শাস্তি হয় না।
যা হোক, এখন সমস্যাটি শাস্তি নির্ধারণ কিংবা দোষী ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া নয়। দুর্ঘটনা ঘটার কারণ খুঁজে বের করাই হতে হবে প্রধান উদ্দেশ্য। যে তিনটি ফেরি পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে সরেজমিনে গিয়ে ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, তা না জেনে শতভাগ সঠিক কারণ বের করা সম্ভব নয়।
কিন্তু একজন অভিজ্ঞ চালক, যে আমাদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তার পক্ষে সম্ভাব্য কারণ অনুমান করে নেওয়া দুরূহ কোনো ব্যাপার নয়।
সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনার বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরা হচ্ছে, যেমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, চালকের অদক্ষতা, স্রোত ও বাতাস।
নিচে এসব কারণ কতটা দায়ী হতে পারে, তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব।
ষড়যন্ত্র?
কোনো চালকই, সেটা ট্রাক চালক হোক বা লঞ্চ চালক হোক, ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ধাক্কা দিবে না, কারণ তাতে তার নিজের জীবনও বিপন্ন হবে। যদি ধাক্কা দিয়ে ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত করা কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আত্মঘাতী বোমাবাজের মত চালক থাকতে হবে। এসব ফেরির চালকরা বিআইডব্লিওটিএ'র চাকরিজীবী।
আমার মনে হয় না, তারা এমন আত্মঘাতী প্রকল্পে জড়াবে। দেশি বিদেশি কোনো চক্র যদি এমন কিছু করতে চায়, আমার মনে হয় না ফেরির ধাক্কায় ব্রিজ ফেলে দেবার মত হাস্যকর কোন কৌশল কেউ অবলম্বন করবে।
চালকের দক্ষতা
যেকোনো যানবাহন চালানোর জন্যই প্রয়োজন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ধীরে ধীরে একজন শিক্ষানবিশ চালক হিসেবে গড়ে ওঠে।
সমুদ্রগামী জাহাজে সমস্ত ন্যাভিগেটরদের চাকরি জীবন শুরু করতে হয় ক্যাডেট হিসেবে। যতই শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হোক না কেন, চালক হতে হলে শিক্ষানবিশ থেকে সবক'টি ধাপ তাকে পার হয়ে আসতে হবে।
উন্নত বিশ্বে ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত, যানবাহন উন্নত, প্রশিক্ষণও উন্নত এবং তাদের সড়কও উন্নত। সেদেশ থেকে একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ চালককে আমাদের মত দেশের খানাখন্দে ভরা রাস্তা এবং বিশৃংঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থার মাঝে গাড়ি চালাতে দিলে সে অসহায় বোধ করবে।
কিন্তু, আমাদের দেশের রাস্তায় অসচেতন পথচারী, রিকশা, নসিমনের পাশ কাটিয়ে প্রতিদিন গাড়ি চালানো একজন বাস ড্রাইভারকে যদি উন্নত বিশ্বে পাঠানো হয়, সবচেয়ে বড় ভয় থাকবে যে এরকম সহজ রাস্তা পেয়ে চালক হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে।
আমাদের নৌপথের অবস্থাও একই রকম। অনিয়ন্ত্রিত অসংখ্য নৌযান, নিয়মকানুন না মানা ছোট বড় নৌকা, অজানা গভীরতা, বয়াবিহীন নৌপথসহ প্রতিদিন নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে একজন চালককে নৌযান চালাতে হয়।
আমাদের ফেরিঘাটগুলো থাকে নড়বড়ে এবং প্রতিনিয়ত ভাঙ্গনের মুখোমুখি। নিঃসন্দেহে বলা চলে, এরকম বৈরী পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ফেরি চালিয়ে চালিয়ে একজন ফেরি চালক উন্নত বিশ্বের যে কোনো চালক থেকে অনেক বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে। এমন একজন ফেরি চালক ১৫০ মিটার প্রশস্ত একটি নৌপথ দিয়ে ১০ মিটার চওড়া একটি নৌযান নিয়ে বের হতে পারবে না, তা অবিশ্বাস্য।
আমাদের চালকদের তাত্ত্বিক জ্ঞান কিংবা উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব থাকতে পারে, কিন্তু দক্ষতা কিংবা অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে বলে মনে করি না।
স্রোত এবং বাতাস
স্রোত এবং বাতাসের বেগ অবশ্যই দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, যখন তা মাত্রাতিরিক্ত এবং অকস্মাৎ হয়। যেমন হঠাৎ করে আসা একটি কাল বৈশাখী ঝড়ে কিংবা অচেনা কোনো বাঁকের কোনো অজানা তীব্র স্রোতের সম্মুখীন হলে, যে কোনো অভিজ্ঞ চালক নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
এসব ফেরি চালকরা প্রতিদিন এখানে ফেরি চালায়, প্রতিটি স্থানের স্রোতের গতি প্রকৃতি তাদের মুখস্ত থাকে। দুর্ঘটনার সময় আচমকা কোনো ঝড়ও বয়ে যায়নি। তাই তীব্র স্রোত কিংবা বাতাসের কারণে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম বলে আমার ধারণা।
তাহলে সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে?
আমাদের দেশে ফেরি ব্যবস্থাপনার কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যতটুকু জানি, ফেরি চলাচলের জন্য প্রতি ঘণ্টা হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানি তেল বরাদ্দ থাকে। ধরে নেওয়া যাক প্রতি ঘণ্টায় কোনো ফেরিটি ১০০ লিটার জ্বালানি খরচ করে। যদি ফেরিটি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে, তাকে ৬০০ লিটার তেল দেওয়া হবে।
এর মধ্যে ফেরি কখনও দ্রুত গতিতে চলে, আবার কখনও পারে ভেড়ার অপেক্ষায় অল্প গতিতে ইঞ্জিন চালিয়ে শুধু ভেসে থাকে, আবার কখনও ভেড়ার পরেও ইঞ্জিন চালিয়ে পন্টুনের সাথে নিজেকে চেপে রাখে। কিন্তু সব মিলিয়ে তেল দেওয়া হবে ঘণ্টা প্রতি একটি নির্ধারিত পরিমাণে।
যদি উদ্বৃত্ত তেল থেকে চালক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের লাভবান হবার সুযোগ থাকে, সেক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করবে যাতে যতটা সম্ভব তেল বাঁচানো যায়।
সব ডিজেল ইঞ্জিনের একটি ইকোনমি স্পিড বা সাশ্রয়ী গতি থাকে এবং সব সময়েই ইকোনমি স্পিড হয় সর্বোচ্চ সক্ষমতার অনেক নিচে। ফলে জ্বালানি বাঁচানোর জন্য চালকের প্রচেষ্টা থাকে যতটা সম্ভব কম স্পিডে বা ইকোনমি স্পিডের কাছাকাছি গতিতে ফেরি চালানো।
যদিও তাতে পরিস্থিতি সাপেক্ষে সেফ ন্যাভিগেশন ব্যাহত হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, স্রোতের অনুকূলে যাবার সময় ইঞ্জিন একদম ধীরগতি করে দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে দুটি ইঞ্জিনের একটি বন্ধও করে দেওয়া হয়।
সাধারণ নৌযানে সবসময় প্রোপেলারের পেছনে একটি হাল বা রাডার থাকে, যা ডানে বামে ঘুরিয়ে জাহাজের দিক পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু যেসব স্পিডবোটে আউটবোর্ড ইঞ্জিন লাগানো হয়, সেখানে আলাদা করে কোনো হাল বা রাডার লাগানো হয় না। সেখানে হালের পরিবর্তে ইঞ্জিনটিকে ডানে বামে ঘুরানো হয়ে, তাতেই বোটের দিক পরিবর্তন হয়।
রাডার সংযুক্ত জাহাজের ইঞ্জিন যদি চলন্ত অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শুধু রাডার ঘুরিয়ে বা স্টিয়ারিং করে জাহাজকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদি তখনও নৌযানের কিছুটা গতি থাকে। কিন্তু যেসব স্পিডবোটে আউটবোর্ড ইঞ্জিন লাগানো থাকে, তাদের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় থাকে না বা স্টিয়ারিংও ফেইল করে বলা যায়।
আরিচা কিংবা মাওয়া ঘাটে যেসব ফেরি আমি দেখেছি তাদের ইঞ্জিন আউটবোর্ড মোটরের মতো, যাদের বলা হয় ডিরেক্ট ড্রাইভ ইঞ্জিন বা আজিপড। চালক রাডার ডানে বামে ঘুরানোর পরিবর্তে প্রপেলার বা পাখা ঘুরিয়ে নৌযানের দিক পরিবর্তন করেন। এসব নৌযানের ইঞ্জিন যদি ধীর গতিতে চলে, কিংবা বন্ধ করে রাখা হয়, নৌযানের স্টিয়ারিং সক্ষমতা অনেক কমে যায় বা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।
এছাড়াও আরেকটি মজার ব্যপার হলো, নৌযান যখন স্রোতের উজানে যায়, তখন সে ভালো স্টিয়ার করে, যদিও নৌযানের গতি কমে যায় স্রোতের বিরুদ্ধে যাবার কারণে।
নৌযান যখন স্রোতের অনুকূলে চলে, তখন তার গতি বেড়ে যায়। কিন্তু, স্টিয়ারিং সক্ষমতা হারায়। এজন্য স্রোতের অনুকূলে যাবার সময় যেখানে নৌপথ খুব সংকীর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক থাকে, সেসব স্থানে ইঞ্জিন পূর্ণ গতিতে চালাতে হয় শুধু দিক নিয়ন্ত্রণ বা স্টিয়ারিং সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।
কিন্তু যখন জ্বালানি বাঁচানো থাকে মূল উদ্দেশ্য, তখন চালক চেষ্টা করে ইঞ্জিন স্পিড না বাড়িয়ে যতটা চালানো যায়।
প্রতিকূল আবহাওয়া কিংবা তীব্র স্রোত, সব ক্ষেত্রেই একটি নৌযানের প্রধান অস্ত্র গতি, যা আমাদের ফেরিগুলো হয়তো প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে না।
আমি পেশাগত ভাবে একজন নৌযান চালক। বিশ্বের বিভিন্ন নৌপথে, অনুকূল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নৌযান চালিয়ে অভ্যস্ত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, সেসব কেস স্টাডি নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা করতে হয়।
একই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন অ্যানালিস্টদের মতবাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হয়। কয়েকযুগ সাগরে অতিবাহিত করার পরেও প্রতিবছর এক দুবার নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হয়, যার প্রধান বিষয়বস্তু থাকে নৌদুর্ঘটনার কেইস স্টাডি। এভাবেই চালকদের দক্ষতা বাড়ানো হয় এবং দুর্ঘটনা রোধ করা হয়।
ওপরে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, তা সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা মাত্র। আসল কারণ উদঘাটনের জন্য অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশনের কোনো বিকল্প নেই এবং তা অবশ্যই পেশাদার ইনভেস্টিগেটরদের দিয়ে করাতে হবে। এছাড়াও কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করানো উচিত, যেখানে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত হবার সম্ভাবনা না থাকে।
সর্বোপরি একটি কথা মনে রাখতে হবে, তদন্তের প্রধান উদ্দেশ্য দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা, কখনোই শুধু দোষী ব্যক্তি খুঁজে বের করা নয়।
- লেখক: নৌ কর্মকর্তা