বিজেপি যে কোনো মূল্যে পশ্চিম বাংলায় বিজয় চাইছে!
পশ্চিমবাংলায় নির্বাচন চলছে। ১৩৫টি আসনের জন্য ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হল। মাসব্যাপী অষ্টম দফার নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যে সহিংসতা এবং যে ঘটনাসমূহ পর্যবেক্ষণ করা গেল তাতে ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটলো বলেই মনে করা যেতে পারে। চতুর্থ দফা নির্বাচন চলাকালীন সহিংসতায় কুচবিহারে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মোট ৪ জনসহ পাঁচজন মৃত্যুবরণ করে। সম্প্রতিককালে অন্য কোন রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। কুচবিহারের সেই ঘটনায় নিহত ৪ জন মুসলিম ও একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
পশ্চিমবাংলার রাজ্য নেতৃত্ব রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষ যে বক্তব্য দিয়েছে তা সরাসরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার অনুকুলের বক্তব্য। 'পশ্চিমবাংলার আগামী নির্বাচনের দিনগুলোতে আরো বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটা উচিত। এমনি বক্তব্য তুলে ধরেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য মানুষকে আরও আতঙ্কিত করে তুলছে। নির্বাচনে হতাহতের ঘটনায় কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন, ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন কুচবিহারের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিজেপির নেতাদের উপর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি করেছে। মমতা ব্যানার্জির উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাতে মমতা ব্যানার্জি পঞ্চম দফার নির্বাচনের আগে কোন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার অবস্থানে থাকলেন না। কারণ তার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং নির্বাচনী প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা, মাঝখানে সময় মাত্র ২ ঘন্টা। সে দিক থেকে মমতা ব্যানার্জি পঞ্চম দফার নির্বাচনের পূর্বে এই নির্বাচনী এলাকাগুলোতে কোন ধরনের নির্বাচনী প্রচার করতে পারলেন না।
গুলিবর্ষণের ঘটনাকে নির্বাচন কমিশন সমর্থন করেছেন। নির্বাচন কমিশন গুলিবর্ষণের ঘটনার পরেই জানিয়ে দিয়েছেন জানমাল রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিবর্ষণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না।
চার দফায় ১৩৫ টি আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আরো বাকি আছে ১৫৯টি আসনের নির্বাচন। ভারতের অন্যতম বৃহত্তর রাজ্যের এই নির্বাচনে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি এক মরণপণ লড়াই নেমেছে। কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী ,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দলটির সভাপতি গত দু'মাসে কতবার রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছেন তার সঠিক তথ্য প্রদান করা এই মুহূর্তে কঠিন। ভারতীয় লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন এই পশ্চিমবাংলায়। পশ্চিমবাংলায় লোকসভার আসন সংখ্যা ৪২টি। উত্তরপ্রদেশের লোকসভায় সবচেয়ে বেশি ৮০টি আসন। উত্তরপ্রদেশে ২০১৪ নির্বাচনে বিজেপির আসন লাভ করেছিল ৭১টি। ২০১৯ এ উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আসন হারিয়েছে ১০টি। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে এবার নেতৃত্ব দিচ্ছেন যোগী আদিত্যনাথ নামক একজন ধর্মীয় নেতা। যিনি রাজ্যটির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরপ্রদেশে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টি আসনে জয়লাভ করেছিল বিজেপি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে ১০টি আসন হারিয়েছে বিজেপি। নোটবন্দিসহ নানান কারণে এই আসন হারায় বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আসন হারানোয় বিজেপিকে শংকিত করে তুলেছে, যে কারণে বিজেপি তার সর্বশক্তি নিয়ে পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।
ভারতীয় সীমান্তের চতুর্দিকে অবস্থিত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক বর্তমানে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের। অথচ পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে বাংলাদেশকে টার্গেট করে তাদের সকল নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে বিজেপি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বন্ধুত্বকে তারা অগ্রাহ্য করছে তাদের নির্বাচনী প্রচারণায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।
আগামী নির্বাচনে যদি নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার পশ্চিমবাংলার ক্ষমতা দখল করে, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একটি নতুন মোড় নেবে কারণ এবার নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার তারা জাতীয় পরিচয়পত্র বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এবং তারা বারবার বলছে যে ভারতীয় পশ্চিমবাংলায় বসবাসকারী মুসলিম জাতিসত্তার মধ্যে বহু শরণার্থী অনুপ্রবেশকারী আছে। এই প্রচারণাটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে পশ্চিমবাংলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিজেপি। এর ফলে এখন এরকম মনে করা যেতে পারে যে, কোন কারণে যদি পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে জিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসে তাহলে পশ্চিম বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হতে পারে-এ শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতিককালে বাংলাদেশের হেফাজত ইসলামের ঘটনার সঙ্গে বিজেপির এই নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল সম্পৃক্ত কিনা, এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভেবে দেখতে হবে। প্রশ্ন জাগে হঠাৎ করে হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের মাটিতে মোদির আগমনকে সামনে রেখে যে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিলো তার গুরু কারণটা কি? তারা কি ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করছে না পশ্চিমবাংলার এই অপরাজনীতিতে প্রভাবিত হচ্ছে?
বিজেপি ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশে আসন হারানোর পরে পশ্চিমবাংলায় আসন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৌশলগতভাবে তার সমস্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে । এবং ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে যে মূল উপাদান যোগ করেছে তা হচ্ছে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীর তথাকথিত গল্প। বিজেপির দলের সভাপতি নাড্ডা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহা কিংবা প্রধানমন্ত্রী মোদী যতবার পশ্চিমবাংলা ভ্রমণ করেছেন, নির্বাচনী জনসভা করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের গল্প ফেঁদেছেন তারা। প্রত্যেক সময়েই পশ্চিমবাংলায় অনুপ্রবেশকারীদেরকে বিতাড়িত করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন। অথচ ২০১৬ সাল থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায় পশ্চিমবাংলা থেকে, কিংবা ভারতীয় রাজ্যগুলো থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সংখ্যা অতীতের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের সংখ্যা বহুগুণ কম। কিন্তু তারপরেও কেন বারবার বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ তুলছে তারা?
আনন্দবাজার পত্রিকা অমিত শাহের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে সে সাক্ষাৎকারে একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন ছিল এ বিষয়ে। আনন্দবাজার পত্রিকা অর্থনীতির সূচক, বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সমস্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে প্রশ্ন রাখে বাংলাদেশ থেকে এ অবস্থায় কেন পশ্চিমবাংলায় অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটবে?
প্রতিউত্তরে অমিত সাহা ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন গ্রামাঞ্চলে এখনো পৌঁছায়নি, বাংলাদেশের যে উন্নয়ন চলছে তা মোটামুটিভাবে শহরাঞ্চলে। আর এর বাইরে উন্নয়ন পৌঁছাচ্ছে গ্রামের ধনিক শ্রেণীর কাছে, কিন্তু গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে এই উন্নয়ন এখনো পৌঁছাচ্ছে না। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন সম্পর্কিত অমিত শাহের ব্যাখ্যা একটি অতি বাড়াবাড়ি বলে মনে করে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা।
অথচ অমিত সাহার এ বক্তব্যের বিপরীতে বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ করে যে কৃষি অর্থনীতিতে বরং গ্রামে শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে এবং গ্রামীণ কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এর পরিমাণ ডলারের হিসাবে ১০ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ১২ ডলার পর্যন্ত কিংবা ১৫ ডলার পর্যন্ত উঠছে।
বাংলাদেশের এই অবস্থানের পরেও অমিত সাহারা বাংলাদেশকে আক্রমণ করছে বারবার, নির্বাচনে বিজয়কে হাসিল করার জন্য। আনন্দবাজার তাকে আরো প্রশ্ন করেন অমিত শাহ কি আগামী লোকসভা নির্বাচনের পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন কিনা? এ প্রশ্নের জবাব তিনি সরাসরি না দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। তবে অমিত শাহ যত তীব্রভাবে বাংলাদেশকে আক্রমণ করছেন তা একটু অতি বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে তার ভ্রমণ তালিকায় যে বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তাতে বোঝা যায় যে তার মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার একটি প্রধান বিষয় ছিল। তার মন্দির ভ্রমণ এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের উপরে বক্তব্য তারই প্রমাণ। বাংলাদেশ ভারতের সাথে তার বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বহু কিছুতেই পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখেছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক