বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
চান্দপুর বেগমগঞ্জ চা বাগানের সাবিত্রী নায়েক ও শামসুল হক
বীরাঙ্গণা, মুক্তিযোদ্ধা জননী সাবিত্রী নায়েকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ২০১৬ সালের মার্চ মাসে। ২৬শে মার্চ সকালে হবিগঞ্জের চান্দপুর বেগমগঞ্জ চা বাগানের এক মন্দিরের চাতালের সামনে তাঁর সাথে আমার কথা হয়। শুরুতে কথা বলতেই চাচ্ছিলেন না। শাড়ির আঁচলে বারবার মুখ ঢেকে ফেলছিলেন।
দক্ষিণ ভারতীয় সাবিত্রীর পূর্বপুরুষ বৃটিশ আমলে চা শ্রমিক হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট এলাকায় এসেছিলেন। সেই থেকেই চা বাগানেই বসতি তাঁদের। একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে তিনি পাক বাহিনীর হাতে অপহৃত, ধৃত ও ধর্ষিতা হয়েছিলেন। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মিলিয়ে ছয় মাস বাঙ্কারে বন্দী ছিলেন।
নিরবচ্ছিন্ন ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'না- মা, সৈন্যরা রবার পরে আসতো।'
এসব লিখতে আমাদের খুব কষ্ট হয় এবং পশ্চিমের বিখ্যাত নারীবাদী তাত্ত্বিক সুসান ব্রাউনমিলারের 'অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ' বইটির কথা আমাদের মনে পড়ে যায়, যেখানে সুসান খুব সাহসিকতার সাথে জানিয়েছেন, 'ধর্ষণ হলো নারীকে ভীতি প্রদর্শনের এক সচেতন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সব পুরুষ সব নারীকে এক নিরবচ্ছিন্ন, ধারাবাহিক ভয়ের ভেতরে রাখে।' এবং এই ক্রমাগত ভীতিবোধই নারকীয় মাত্রা পায় যে কোনো যুদ্ধ, জাতিগত বা ধর্মাশ্রয়ী দাঙ্গা বা সবলের হাতে দুর্বলের নিপীড়নের সময়। যেমনটি ঘটেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও।
ফেরা যাক সাবিত্রীর কথাতেই। বিজয় মুহূর্তে পরাজিত পাক সৈন্যরা পালানোর সময়ে সাবিত্রীকে বাংকার থেকে তুলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে যায়, 'আমার গায়ে তখন কাপড় ছিল না। মিলিটারির লোকরা আমাকে এই চা বাগানের সামনেই ফেলে রেখে যায়। তখন আমাদের চা বাগানেরই একটা ছেলে- যে আমাকে চিনত, আমাকে কাঁধে তুলে আমার বাবা-মার কাছে নিয়ে যায়। আমি তখন প্রায় বেহুঁশ ছিলাম।'
যুদ্ধের কয়েক বছর পর ধর্ষিতা সাবিত্রীকে তার সম্প্রদায়ের কেউ বিয়ে করছিল না বলে তিনি এক বাঙালি মুসলিম চা শ্রমিককে বিয়ে করেন। ধর্ম বদলাতে হয়। তবে বীরাঙ্গনা হিসেবে চা বাগান এলাকায় সবাই তাঁকে এক নামে সাবিত্রী হিসেবই চেনে। বিয়ের শুরুতে জীবনটি সুখের হলেও পরে স্বামী আরেকটি বিয়ে করেন। বর্তমানে সাবিত্রীর এক ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি থাকলেও মাঝে মাঝেই ফেলে আসা পরিবারের কথা মনে পড়ে।
যদিও বাবা-মা মারা গেছেন তাঁর, তবে ফেলে আসা স্বজনদের খুঁজতে ভাই ও বোনের সংসারে মাঝে মাঝে বেড়াতে যান। তাঁরাও তাঁকে কয়েক দিনের আতিথ্য দিতে অস্বীকৃত হন না।
সেবার হবিগঞ্জ চা বাগানে তেলিয়াপাড়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কৃষক মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের সাথেও আমার কথা হয়। যুদ্ধের সময় কৃষক শামসুল হক কৃষিকাজ ছেড়ে ট্রেনার-৩ রাইফেল হাতে যুদ্ধ করেছেন। বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম বা বীর প্রতীক পদক বোঝেন না তিনি। তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধ হলো তাঁর বন্ধু মান্নাফের শহীদ হবার যুদ্ধ।
ভাদ্র মাসের কোনো এক ঘোর বর্ষার দিনে মান্নাফ টিলার ওপর যুদ্ধ করতে করতে মারা গিয়েছিলেন। সজল চোখে বারবারই তিনি তাই বলছিলেন, 'ঐ যে যুদ্ধে মান্নাফ মারা গেল? ভাদ্র মাস। আমি ইংরেজি মাস জানি না বাবা! টিলার ওপর- ঝুম বৃষ্টি সেদিন- সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। দিনের শেষে মান্নাফ মারা গেল। আর তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধও বড় যুদ্ধ ছিল।'
রাজা আসে, রাজা যায়। সেক্টর কমান্ডারদের জীবনী গোগ্রাসে গেলে বাঙালি মধ্যবিত্ত। শুধু এক কৃষক শামসুল হকের কাছে মুক্তিযুদ্ধ হলো তাঁর বন্ধু মান্নাফের মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম।
সত্যি বলতে, রাজধানীকেন্দ্রিক আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের পরিসর ছেড়ে দুই পা বাইরে গেলেই আজো বাংলাদেশের ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের আনাচে-কানাচে পাওয়া যায় একাত্তরের অসংখ্য বধ্যভূমির সন্ধান, মেলে গণহত্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের ধারাভাষ্য, যেমনটা মিলেছিল এই ২০২১-এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে, যখন অন্তর্জালে খুলনার চুকনগরে একদিনে ভারতে পলায়নরত দশ হাজার সংখ্যালঘু নর-নারী হত্যার বিবরণ পড়ে কৌতূহলী হয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহে খুলনা গিয়েছিলাম।
চুকনগর বধ্যভূমির সেই ভয়াল গণহত্যার কয়েকজন সাক্ষীর সাথে কথা বলার পরদিন গল্লামারী বধ্যভূমিও যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়েছিল। সেই চুকনগর গণহত্যার কয়েকজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীর সাথে আলাপ হয়েছে আমার।
বধ্যভূমির হৃদয় থেকে: মাঝি কৃষ্ণপদের জবানবন্দি (বয়স ৭০/৭৫)
এ বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি খুলনার মানিকতলায় আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্র 'নিজেরা করি'র রেস্ট হাউস থেকে একটি সিএনজি করে ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বধ্যভূমির সামনে আমি যখন নামি, তখন সেই বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধের সামনে সবার আগে কৃষ্ণপদ নামে যে বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ হয়, তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়া স্কুল পড়া মধ্যবিত্তের পক্ষে শুরুতে একটু কঠিনই হবে। যেমন, আমি তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম- একাত্তর সালে তাঁর বয়স কত ছিল, তখন তিনি বললেন, তাঁর বয়স তখন ৪০-৪৫ ছিল। কিন্তু ৫০ বছর আগে তাঁর বয়স ৪০/৪৫ হলে এখন ৯০-৯৫ হবার কথা। সেটা তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল না। দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁর বয়স বোধ করি ৭০-৭৫ হবে।
কাজেই, আমি যখন প্রতিবাদ করে বললাম, তাঁর বয়স তখন ২০-২৫ হবার কথা, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, তখন তাঁর বয়স ৪০-৪৫ হলেও এখন ২০-২৫ বছর! তারপরও হাল না ছেড়ে আমি ইন্টারভিউ নেবার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
যখন জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁদের এই এলাকায় একাত্তর সালের ঠিক কখন গণহত্যা শুরু হয়েছিল, তিনি বললেন, ডিসেম্বর মাসে এটা ঘটেছিল। সেটা সম্ভব নয় এজন্য যে, ডিসেম্বরে যুদ্ধ কিনা বলতে গেলে শেষই হয়ে যায়! বুঝলাম, গ্রামের মানুষ ইংরেজি তারিখ তো আসলে ভালো জানে না। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন বাংলা মাস কোনটি ছিল? চৈত্র বা বৈশাখ মাস ছিল কিনা? তিনি শেষে বললেন, তখন ধান কাঁচা ছিল, মানে চৈত্র বা বৈশাখই। এভাবে তাঁর সাথে আলাপ শুরু হলো।
একাত্তরে এই এলাকায় এক বড় গণহত্যা হলেও তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন অলৌকিকভাবে। সাদাসিধেভাবেই জানালেন, যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই খানেরা বা পাঞ্জাবিরা এই ম্যাসাকার চালায়নি। এমনকি তিনি কিনা মাঝি হিসেবে তখন খানেদের অনেক সময় নৌকা পারাপারও করিয়েছেন। কিন্তু যেদিন কিনা আশপাশের নানা জায়গা- যেমন দাকোপ, পাইকঘাটা, বটিয়াঘাটাসহ পার্শ্ববর্তী সব এলাকার বিশেষত: সংখ্যালঘু পরিবারগুলো জমায়েত হয়ে যশোর রোড দিয়ে ভারতে যাবার চেষ্টা করছিল, এক বিহারী পশ্চিমা বা খানেদের (পাঞ্জাবি সেনা) জানিয়ে দেয়। খানেরা তখন জিপ গাড়ি নিয়ে আসে।
ক'জন খান সেনা এসেছিল- জিজ্ঞাসা করায় বৃদ্ধ বলেন, তিন জন এসেছিল। তিন জন সৈন্য এই তল্লাটে কি সত্যি সত্যি হাজার হাজার মানুষ একদিনে মেরে ফেলতে পেরেছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধ জানান, তাদের হাতে বন্দুক ছিল। তবে পরে এই এলাকার দুই শিক্ষিত, মধ্য শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে জানতে পারি, প্রায় ২০-২৫ জন পাঞ্জাবি সেনা অফিসার এসেছিল।
যাহোক, কৃষ্ণপদ তাঁর খুড়তুতো ও জ্যাঠতুতো দুই ভাই শিবু ও চানকে নিয়ে- যাদের একজন শিশু ও একজন অসুস্থ ছিল, তাদের নিয়ে ভারতে পালানোর আশায় নৌকায় উঠেছিলেন। কিন্তু নৌকায় ওঠার সময়েই তাঁর হাতে গুলি লাগলে একটি আঙুল চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় আর তিনি মৃতের ভান করে নদীতে ঝপ করে পড়ে যান ও অনেকক্ষণ ডুবে থাকেন। পাঞ্জাবিরা ভাবে, তিনি মারা গেছেন এবং আর তাঁকে খোঁজেনি।
নদীতে দীর্ঘ সময় কৌশল করে ডুবে থাকার পর সাঁতরে নদীর অন্য পারে উঠে তিনি চুকনগর বাজারে যান, যেখানে ভারতের সীমান্তের উদ্দেশ্যে পলায়নরত বৃহত্তর খুলনার নানা এলাকার প্রায় দশ হাজার নর-নারী আশ্রয় নিয়েছিলেন। অনেক নর-নারীই স্থানীয় বাজারে একটু থেমে চিঁড়া-মুড়ি বা কিছু খাবার সংগ্রহ করছিলেন। সেসময় পাকবাহিনী বাজারে ঢুকে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। অনেক অসহায় নর-নারী তখন পাশের মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিলে সেনাবাহিনী সেখানে ঢুকেও গুলি করতে থাকে।
'সেদিন প্রথম গুলিটা হয়িছিলো এই আমি যেখানে দাঁড়ায়ে আচি, তার সামনে। চিকন মোড়ল নামে একজন তার নিজের ভুঁইতে জমি চাষ করতিচিল। হাতে ছিল কাস্তে। তখন মেলটারির জিপ সামনে দিয়ি যাচ্ছিল। ঐ তেলকমের (টেলিকমের) খাম্বার সামনে দিয়ি ওরা জিপে করি আসচিল। কি মনে করি খানেরা চিকন মোড়লের দিকি গুলি ছুঁড়লো আর ও লুটায়ি পড়লো। এরপর ঐ যে এখন পাকা রাস্তা দেখিছেন, ওখানেও নদী ছিল। ভদ্রা নদী এখন অনেক শুকায়ি গেচে। নদীর ওপর সার সার করি অন্তত পঞ্চাশটা লৌকো। লৌকোর ভেতর মানুষজন সব বসা। ভারতে পালাতিচে। সেই নৌকাতেও সব গুলি করতিচে। আমি আমার দুই ভাইকে নিয়ি তিনো ভাই মিলি একটা লৌকোয় উটিচিলাম। আমি লৌকার মুড়িতে বসা। তখন শুরু হলো গুলি। বুদ্দি করি তখন ঝপাত করি নদীর জলে পড়ি গেলাম যেন মরি গিচি। এভাবে অনেকক্ষণ ডুব দিয়িচিলাম। আমি সব কাজ পারতাম। নৌকা বাইতি পারতাম। বড় নদীতি ঝাঁপ দিয়ি সাঁতরাতি বা অনেকক্ষণ ডুব দিয়ি থাকতি পারতাম। তাই বাঁচি গেইচি।'
পরে নদী সাঁতরে অপর তীরে চুকনগর বাজারে গিয়ে দেখেন, ততক্ষণে ঘটে গেছে বিভীষিকা জাগানো গণহত্যা। সার সার লাশ স্তূপাকারে পড়ে আছে। প্রাণ বাঁচাতে বহু নর-নারী গাছের ডালে উঠে বসেছিলেন। সেখান থেকেও তাদের গুলি করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। সৈন্যরা হত্যা শেষে মাত্রই তখন বাজার ছেড়ে চলে গেছে। আর এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান কৃষ্ণপদ।
বর্তমানে তিনি বয়সজনিত কারণে আংশিক পক্ষাঘাতে ভুগছেন। অনেক দুঃখ নিয়ে তিনি আরও জানালেন, ১৯৭১ সালে তাঁদের তল্লাটের মূল গণহত্যা শুরু হয়েছিল কিছুটা সামনের ধান ক্ষেতের ওখানে। এখন যেখানে ধান ক্ষেত, সেখানে! কিন্তু সরকার ওই জায়গা আবাদী জমি বলে ওখানে স্মৃতিসৌধ না বানিয়ে স্মৃতিসৌধ বানিয়েছে এমন এক জায়গায়, যেখানে কিনা তাঁর পারিবারিক জমির ৪৫ শতক সরকারকে দিতে হয়েছে।
শুনে থতমত আমি জানতে চাইলাম, সরকার তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে কি? তিনি বললেন, এক শতক জমির দাম যেখানে কিনা তিন লাখ টাকা, সেখানে তিনি পেয়েছেন মাত্র দুই লাখ টাকা। অবশ্য তাঁর আরও ২০-২২ বিঘা জমি আছে। জমির শোকে কাতর বৃদ্ধ তাই মাঝে মাঝেই এই বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের সামনে এসে বসে থাকেন।
মোস্তাফিজুর রহমান: আমার চাচাতো বোন আবেদা গুলি খেয়ে মারা গেছিল
কৃষ্ণপদের সাথে কথা শেষ করে স্থানীয় এক চায়ের দোকানে যেতে সেখানে এক যুবক জানালেন, তাঁর বাবাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং আমি তাঁর বাবার সাথে কথা বলব কিনা? তাঁর বাবা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে ও পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অফিসে একাধিকবার গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছেন বলেও জানালেন। কাজেই তাঁদের বাসায় যেতে হলো।
মোস্তাফিজুর রহমান (বয়স: ৭০) নামে এই ভদ্রলোক জানালেন, তাঁর বাবা স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। তিনি তখন ১৮-২০ বছরের যুবক এবং মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে খুবই উদ্দীপ্ত।
'সেই দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ২০শে মে। কয়েকদিন ধরেই খুলনার বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, রামপাল, ফুলতলা, মোরেলগঞ্জের হাজার হাজার হিন্দু পরিবার কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ নৌকায়, আবার কেউ পায়ে হেঁটে আমাদের এদিকে আসছিল। পাশেই যশোরের কেশবগঞ্জ-মণিরামপুর সীমান্ত পথে ভারতে পালাবে তারা। আমরাও অনিশ্চিত বোধ করছি। আমাদের বাসায় পাঁচ-ছয়টি হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। ঘটনার দিন একটা জিপ গাড়ি ও একটা পিকআপে করে প্রায় ২০-২৫ জন পাঞ্জাবি, খান সেনা এদিকে দিয়ে যাবার সময় কি মনে করে সৈন্যদের পাঁচ-ছয় জনের একটা দল আমাদের বাসাতেই ঢুকে পড়ে। ওরা আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং হিন্দুদের বেশি খুঁজত। সৈন্যরা আমাদের বাসাতেই ঢুকে পড়ে এবং প্রথমে আমার আব্বার দিকে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছোঁড়ে; তবে ভাগ্যক্রমে সেটি সামনের দেয়ালের প্লাস্টারে লাগে। তবে আমার চাচাতো বোন আবেদার বয়স তখন ১০-১১ বছর হবে, সে জানালার পাশে ছিল আর একটা গুলি সরাসরি ওর বুকে গিয়ে লাগে। আমি পালিয়ে যাই সামনের বাজারে।'
এরপর সেই ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো। নদীতে নৌকায় পলায়নরত সংখ্যালঘুদের ওপর ব্রাশফায়ার হচ্ছে। জীবনে বাঁচতে যারা গাছের ওপরে পাতা দেখে পাতার আড়ালে লুকাতে চাইছে, তাদের পাখির মত গুলি করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই যেসব গাছে বেশি পাতা, সেসব গাছে উঠে বসছিল যেন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা যায়। তবু রেহাই পায়নি। পুকুরের রক্ত লাল হয়ে গিয়েছিল। দুর্গন্ধে গোটা তল্লাটে হাঁটা যায় না। সেই সময়ের আরও অনেক কিশোর-তরুণের মতো তখন তিনি সীমান্ত পথে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ট্রেনিং নেন। দেশ স্বাধীন হবার আগে আগে এক বা একাধিক অপারেশনে অংশও নেন। স্বাধীনতার পর শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত হন ও বিয়ে করেন। তাঁর বড় সন্তান অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।
'পৃথিবীর ইতিহাসে জালিওয়ানাবাগ বলেন আর হিটলারের হাতে ইহুদি নিধন বলেন, একদিনে দশ হাজার মানুষ আর কোথাও খুন হয়নি।'
অনিল বিশ্বাস (বয়স: ৮০): সেই দিনির কথা এখনো ভুলতি পারি না!
কৃষক অনিল বিশ্বাস মোস্তাফিজুর রহমানের বাসায় এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগের বিষয়ে কথা বলতে। তিনি বললেন, তাঁর বাড়ি বরাটিয়া গ্রামে। একাত্তরে তিনি ত্রিশ বছরের যুবক আর তখন পুঁটিমারী এসেছিলেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। যে কোনো সময় খানেরা এসে তুলকালাম করতে পারে, এই ভয়ে চুকনগর বাজারে গিয়েছিলেন দশ কেজি চাল কিনতে। তখনই গুলি শুরু হয়।
'সামনের তাঁতীপাড়ায় কত মানুষ যে মারা গেল! একটা মন্দির ছিল। সেটা এখনো আছে। তবে তাঁতীপাড়ায় আর তেমন মানুষ নেই। আমার অনেক ভাগ্যে আমি সেদিন বাঁচে গেইচি। কিন্তু সেই দিনির কথা এখনো ভুলতি পারি না!'
স্থানীয় ইতিহাসবিদ শফিকুল ইসলাম (বয়স: ৬৫-৬৬)
মুক্তিযুদ্ধের সময় শফিকুল ইসলামের বয়স ছিল ১৫-১৬ বছর। মাত্র মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে সে সময়ের সব স্মৃতিই তাঁর এখনো স্পষ্ট মনে আছে।
'মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৩৫-৩৯ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে সেই হার মাত্র ১৫ শতাংশ। চুকনগরের গণহত্যা আজো সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর যারা বেঁচে গেছিল, তাদের কাছে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি।'
শফিকুল ইসলাম বলেন, যে কোনো কারণেই হোক, খুলনার ভূতের বাড়ি এলাকায় দেশের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। জামাত নেতা এ.কে.এম. ইউসুফ এই ক্যাম্প খুলেছিলেন। যশোর যেহেতু চুকনগর থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে, হাজার হাজার সংখ্যালঘু পরিবার তখন চুকনগর হয়ে সীমান্তে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
'প্রথম গুলিটা যার ওপর হয়েছিল, সে ছিল একজন কৃষক। তার হাতে ছিল একটা কাস্তে, আর মিলিটারির জিপ দেখে সে কেন জানি কাস্তে হাতটা তুলে তাদের দিকে নেড়েছিল। অমনি মিলিটারি তার দিকে গুলি ছোঁড়ে। তারা ভেবেছিল বাঙালিরা না আক্রমণ করা শুরু করে!'
'আমার বয়স তখন পনেরো বছর। সকাল দশটার দিকে গুলির আওয়াজ শুরু হলে বাবার সাইকেল নিয়ে বের হলাম। যদিও বাসায় বড়রা বের হতে মানা করেছিল। ভদ্রা নদীর পানি লাল হয়ে গেছিল। আমাদের বাসা থেকে কিছু দূরের একটা পুকুর। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের গরমে সেখানেও ত্রিশ-চল্লিশটা লাশ সার সার পড়ে আছে। পুকুরের পানি গরমে শুকিয়ে কাদা-রক্তে একাকার। নদীর পাড়ে গেলে বিশেষত জোয়ার আর ভাটার সময়ে বড়রা যেতে মানা করত। উপুড় হওয়া সব লাশ ভাসছে। বেশির ভাগই হিন্দুদের লাশ। মুসলিমরাও যারা মারা গেছে। সবার লাশ একত্র করে গর্তে ফেলার অবস্থা নেই। তখন মাছ খাওয়া যেত না। এত বড় গণহত্যা আমরা নিজের চোখে দেখেছি।'
চুকনগর বধ্যভূমির কেয়ারটেকার (বয়স: ৬২)
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ভদ্রলোকের নামটি তাড়া-হুড়ায় নোট নেওয়া হয়নি। একাত্তর সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। তাঁর সাথে ভদ্রা নদীর পাশে একটি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হলো।
'ঘটনার দিন আমার আব্বা আমাকে বললেন, আজ তোর স্কুলে যাতি হবে না। দেশে কখন কি হয়। সামনে হাট বসিছে। হাটে বেতের ধামায় কিছু চাল নিয়ি আয়। আব্বা আমারে টাকাও দিলেন। হাটে গিয়ি দেখি হাজারে হাজারে হিন্দু পরিবার। বাজারের সামনে ভদ্রা নদীতে সার সার নৌকা। ওরা সব ভারতে পালাতিছে। পথে বাজার দেখি নৌকা থামায়ি অনেকে খাবার কিনতি উঠিছে। এমন সময় শুরু হলো গুলি। আমি জীবন বাঁচাতি নদীতি ঝাঁপ দিলাম। তারপর সাঁতরি অন্য পারে আমার মামা বাড়ি গিয়ি উঠলাম। সেই রাতে মামাবাড়িই থাকলাম। সকালবেলায় আব্বা আসলেন আমার খোঁজ নিতি। মন খারাপ করি বললেন, এত মানুষ মারা গেইচে। চলো, আমরা একবার গিয়ি দেখি।'
চুকনগর বধ্যভূমির কেয়ার টেকার যা জানালেন, সেই ভাষ্যমতে, ভদ্রা এখন শুকিয়ে গেছে, তবে একাত্তর সালে ভরা নদী ছিল। মন্দিরের সামনে একটি বাজার ছিল যেখানে একাত্তর সালের ২০শে মে অসংখ্য সংখ্যালঘু পরিবার ভারতে পালানোর পথে এসে থেমে শুকনো চিঁড়া-মুড়ি... এসব খাবার কিনছিল। তখনই পাকবাহিনী এবং স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীরা এলে অসংখ্য মানুষ প্রাণ বাঁচাতে মন্দিরের পেছনে একটি বট গাছের শেকড়ের নিচে বা কেউ কেউ গাছের ডালে ও পাতার আড়ালে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পাকবাহিনী তখন গাছে আশ্রয় নেওয়া মানুষদেরও গুলি করে মাটিতে ফেলে দেয়। মন্দিরের চাতালে আশ্রয় নেওয়া সব নর-নারী-শিশুই খুন হয়। ভদ্রা নদীতে লাশ ভেসেছিল বহু দিন। দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়েছিল।
এই মাঝবয়সী মানুষটি তখন প্রাইমারি ক্লাসের শিশু। গণহত্যার পরে তাঁর বাবা তাঁকে ঘটনার নিমর্মতা দেখান। যুদ্ধের পর দারিদ্র্যে যে শুধু পড়তে পারেননি, তা নয়। সম্ভবত এমন নির্মম গণহত্যা তাঁর শিশু মনে প্রভাব ফেলে থাকবে, যা তাঁকে আর স্বাভাবিক করেনি। নিজে জন্মসূত্রে সংখ্যাগুরু হয়েও শৈশবের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ভোলেননি।
এক দিনে ১০ হাজার সংখ্যালঘু নর-নারী-শিশু ঐদিন খুন হয়। লাশগুলোর পায়ে দড়ি বেঁধে জোয়ারের সময় ঠেলে দেওয়া হতো, যাতে ভাটায় আর না ফেরে। এ কাজটা করতে স্থানীয় বাঙালিরা কিছু বিহারীকে নিয়োগ দিয়েছিল, যেহেতু 'বিহারীদের জান কড়া (শক্ত)।' শেয়াল-কুকুর-কাক-চিল-শকুন এসে তো খেতই।
নদীতীরে সেই বটগাছটি পরে খুলনা অঞ্চলে নব্বই দশকে চিংড়ি চাষের জন্য জলের লবণাক্ততায় মরে গেছে। স্থানীয় বাজারটি এখনো আছে। আজো খুলনার বটিয়াঘাটা পাইকগাছা এলাকায় কিছু সংখ্যালঘু গ্রাম আছে, যেখানে কমপক্ষে ৬০০ বিধবা আছেন, যারা একাত্তরে বিধবা হয়েছিলেন বলে জানা গেল।
একাত্তরের ২০শে মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় একটি স্থানীয় বাজার ও বাজার সংলগ্ন মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া ও ভারতে পলায়নরত হাজার হাজার সংখ্যালঘু নর-নারী যেদিন খুন হয়, দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, খুন হবার কিছু আগে সৈন্য আসছে শুনে তারা ভেবেছিল, হয়তো ভারতীয় সৈন্য আর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাঁচাতে আসছে; আর তাই মনের আনন্দে অনেক নারী উলুধ্বনি দিয়েছিল। তারপরই পাক সৈন্যরা এসে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে।
দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত একাত্তরের বধ্যভূমিগুলোর ভেতরে চট্টগ্রামে ১১টি, গাইবান্ধায় ৯টি, নীলফামারিতে ৬টি, মুন্সীগঞ্জে ৫টি, যশোরের রাজবাড়িতে ৩টি, ফরিদপুর-নরসিংদী-কিশোরগঞ্জ-পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁওয়ে ৪টি করে বধ্যভূমি, টাঙ্গাইল-শেরপুর-রংপুর-সুনামগঞ্জ-ঝিনাইদহ-খুলনা-পিরোজপুরের প্রতিটি জায়গায় দুটো করে বধ্যভূমি এবং লালমনিরহাট-দিনাজপুর-হবিগঞ্জ-বাগেরহাট ও ভোলার প্রতিটি জায়গায় একটি করে বধ্যভূমি রয়েছে [তথ্যসূত্র: https://www.thedailystar.net/killing-fields-1971-our-owes-our-strength-1... ]। এছাড়াও দেশের নানা জায়গাতেই এখনো রয়েছে বহু অনাবিষ্কৃত বধ্যভূমি। বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এইসব বধ্যভূমির যথাযথ আবিষ্কার ও সংরক্ষণ করবেন, এটাই প্রত্যাশা।
এ বছর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশতম পূর্তি। সাম্প্রতিক সময়ে হাজার প্রতিবন্ধকতার বিন্ধ্যাচল ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি সারা পৃথিবীর অর্থনীতিবিদদের কাছে 'দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স' নামে ভূয়সী প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের কাছে এক ধাঁধার ঘোর, সারা বিশ্বের বিস্ময়। তবে এই উত্থানপর্বে আমরা যেন ভুলে না যাই লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, অসংখ্য মায়ের সম্ভ্রমহানির বেদনা।
কবির ভাষায় বলতে হলে: 'বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা/ এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা?'
- লেখক: কথাসাহিত্যিক