সিনহা আমাদের জর্জ ফ্লয়েড?
কখনো কখনো অবিচারের শিকার কোনো মানুষ ক্ষমতার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এমন এক অসাধারণ প্রতীকে পরিণত হন, যে প্রতীক দানবতুল্য বিধিব্যবস্থায় ঝাঁকুনি দিতে গণমানুষকে একতাবদ্ধ করার মাধ্যমে সামাজিক শক্তি সচল করে তোলে। এই বৈশ্বিক মহামারির কালে, জর্জ ফ্লয়েড ও মেজর সিনহা এমনই অবিচারের- বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দুই শিকার।
বর্ণবাদের আধিপত্যে নিজেকে বলবান ভাবা এবং মানব মর্যাদা ও কালো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার একেবারেই উপেক্ষাকারী পুলিশের হাতে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ফ্লয়েডের নিহত হওয়ার ঘটনায় ব্যাপকমাত্রায় ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ যত দ্রুত সম্ভব নিতে উৎসাহিত করেছে: পুলিশের সংস্কার।
পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারে লাগাম টানার এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের জন্য তাদের কৈফিয়তের ব্যবস্থা রাখার উদ্দেশ্যেই এইসব সুদূরপ্রসারী সংস্কার। সংস্কারগুলোর মূল বিষয়টি হলো- মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করা।
ওই সংস্কার পুলিশ ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। অতীতে এ ধরনের যটপট সাড়া দেখার ঘটনা বিরল। ফলে, মে মাসে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হাতে ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সংস্কারকে ত্বরান্বিত করেছে।
দুই মাস পর, সেখান থেকে ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরে, বাংলাদেশে পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূত খুনের শিকার মেজর সিনহা হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে; এর প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জাগিয়েছে পুলিশি ব্যবস্থায় পরিবর্তনের আশা।
বেআইনি হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করে, পাঠানো হয়েছে কারাগারে। গঠন করা হয়েছে একটি উচ্চ ক্ষমতাধর তদন্ত কমিটি। এলিট ফোর্স- র্যাব করছে ওই মামলার তদন্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের সাড়া একেবারেই নজিরবিহীন।
এ দেশে গত দেড় দশকে যে ৪ হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার অন্য কোনোটাতেই এ ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ফলে মেজর সিনহার মর্মান্তিক মৃত্যু যেন সেই পাহাড় সরিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে হয়।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর হত্যার বিরুদ্ধে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) বেশ জোরাল আওয়াজ তুলেছে। এই পদক্ষেপ মামলাটির ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে ভূমিকা রাখবে।
রাওয়ার গঠন করা একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল এই মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে পর্যবেক্ষণ করবে। এমন উদ্যোগ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সংগঠনটির প্রধান- লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোঃ মইনুল ইসলাম বলেন, 'আইনের অনেক ফাঁকফোঁকর রয়েছে। অপরাধ করে যে কেউ সেগুলো দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে; আমরা এমনটা অতীতে দেখেছি।'
এই পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল মইনুল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন- পুলিশের সংস্কার। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান আইনজীবীদের নিয়ে গঠন করা বিশেষজ্ঞ কমিটি পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ উপস্থাপন করবে।
পুলিশ সংস্কার একটি বহু পুরনো ইস্যু। এ ব্যাপারে কিছু বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলোর কোনো বাস্তব ফল দেখা যায়নি।
সমস্যাটি একেবারেই শিকড়ের গভীরে ছড়িয়ে রয়েছে। নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে বছরের পর বছর ধরে একের পর এক সরকার পুলিশি শক্তির অপব্যবহার করে এই বাহিনীর পেশাদারিত্বকে ক্ষয় করে ফেলেছে। তাছাড়া, ক্ষমতার অপব্যবহারের জবাবদিহিতার অভাবে দায়মুক্তি পাওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মেজর সিনহা হয়েছেন সেই দানবের শিকার।
তার মৃত্যু অবশ্য পুলিশ সংস্কারের ঘণ্টা পুনর্বার বাজিয়েছে- যা কি না সময়ের দাবি।
যুক্তরাষ্ট্রে যে সংস্কারগুলো করা হচ্ছে, হিংস্র ও খুনে পুলিশগিরির শেষ টানতে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের ক্ষেত্রে সেগুলোকে খসড়া প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুলিশ সংস্কারের উদ্দেশ্যে নির্দেশিত একটি কার্যনির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।
ট্রাম্প বিশেষত উল্লেখ করেছেন, ওই মানদণ্ডগুলোতে চোকহোল্ডের (বা, পিছমোড়া করে ঠেসে ধরা) ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ যুক্ত করতে- যে বিশেষত বিতর্কিত কৌশল বেশ কিছু আফ্রিকান-আমেরিকানের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে- 'যদি না কোনো কর্মকর্তার জীবন ঝুঁকিতে না পড়ে'।
রাজ্য আইনসভাগুলোতে দেওয়া ন্যাশনাল কনফারেন্সের হিসেব মতে, ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ৩১টি রাজ্যে পুলিশ সংস্কারের প্রায় ৪৫০টি প্রস্তাব জাহির করা হয়েছে।
ফ্লয়েডের মৃত্যুকালে অনেক রাজ্যই তাদের বিধানসভার নিয়মিত অধিবেশন শেষ করে ফেলেছিল; তাই তারা পুলিশের জবাবদিহিতার বিষয়টি আগামি বছর উত্থাপনের পরিকল্পনা করছে। তবে কিছু রাজ্য এ বছর বিশেষ অধিবেশন বসাচ্ছে এবং বাকিরা নিয়মিত বিধানসভার ক্যালেন্ডারে বিল পাস করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে সম্প্রতি সিএনবিসির একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার আসন্ন সংস্কারকে ধরা যাক। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনপ্রণেতারা প্রায় ডজনখানের পুলিশি সংস্কার আইন পাস করার তোড়জোর করছেন।
তার মধ্যে একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের মাত্রারিতিক্ত শক্তিপ্রয়োগের কারণে কেউ যদি আহত হন কিংবা মারা যান কিংবা চোখের সমানে অন্য কোনো কর্মকর্তার শক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আটকাতে ব্যর্থ হন- তাহলে তাদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আরও বলা হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার অপরাধ করার পরিস্থিতিতে কাছে থাকা অন্য পুলিশ কর্মকর্তা যদি মধ্যস্থতা না করেন, তাহলে তাকেও সেই অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে।
আরেকটি প্রস্তাবে, পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে আহত কিংবা নিহত কোনো সন্দেহভাজন অপরাধী ও তাদের পক্ষের লোককে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
জর্জ ফ্লয়েড এখন যেকোনো সাহায্যের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। কিন্তু তার মৃত্যু এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটা সংস্কারগুলো যেকোনো নাগরিকের, বিশেষ করে দীর্ঘদিন পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশ ব্যবস্থার শিকার হওয়া আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মেজর সিনহা আমাদের জর্জ ফ্লয়েড হয়ে উঠুন। তার সর্বাত্মক আত্মত্যাগে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত পুলিশি সংস্কারের সূচনা হোক- যেন একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যেটি অনিয়ন্ত্রিত বিচারবহিভূর্ত হত্যাকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরবে।
সিনহার মৃত্যু এইসব পরিবর্তন আনার অসাধারণ মুহূর্তগুলোর প্রস্তাব রাখছে। যদি এটিকে যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে সিনহা ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার বাকি সবার বিদেহী আত্মার প্রতি নতুন করে অবিচার করা হবে।
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
মূল লেখা: Is Major Sinha our George Floyd?