যখন ধর্মে ভাগ দেশ, সমাজ ও মানবতা
ধর্মের দ্বারা বিভাজনই বাঙ্গালি জাতিকে বিভক্ত করেছে এবং বিভক্ত রাখছে। ধর্মীয় জায়গা থেকে কারো নাগরিকত্বের বিষয়টিকে দেখা অধিকতর গর্হিত মনে করি।
আজ যদি ভারত একটি 'নেশনে' পরিণত হতে পারত, তাহলে আজকের বিজেপি ধর্ম সম্পর্কে তার যে দৃষ্টিভঙ্গী, তা নিয়ে এইখানে আসতে পারে না । বিজেপি কেন সফল হয়েছে, তার কারণ হলো গত ৭০ বছর ধরেই মূলত ধর্মের জায়গাটাকে অমীমাংসিত রাখা হয়েছে ।
গান্ধীর ওপরে তলস্তয়ের প্রভাব ছিল অসামান্য। মৃত্যুর এক মাস আগেও তলস্তয় ধর্ম প্রসঙ্গে চিঠি লিখেছিলেন গান্ধীকে। তারা উভয়ে 'মানবিক ভ্রাতৃত্ববোধ' এবং 'সকল সৃষ্টির ঐক্যে'র প্রবক্তা ছিলেন। তলস্তয় চার্চ ও তার ট্রাডিশনের কঠোর বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। তলস্তয় মানুষকে দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন। মুক্তচিন্তার এবং মুক্তচিন্তার বাইরের মানুষ। আজকের সংকটকে বুঝতে হলে আমাদের মুক্তচিন্তার মানুষ দরকার। যারা তলস্তয়ের ভাষায়, সত্য বুঝতে নিজের 'কাস্টমস, প্রিভিলেজেস এবং ফেইথ' ত্যাগ করতে হলেও তাতে সম্মত থাকবেন। গান্ধীজিকেও এখানে লাগবে, কারণ অজনপ্রিয় হওয়া বা বাকস্বাধীনতার পরিণতি ভয়ংকর জেনেও সত্য প্রকাশ করতে হবে।
ইউরোপে ধর্ম কম জ্বলাতন করেনি। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ এখনো অর্থোডক্স চার্চকে অনুসরণ করে । কিন্তু জাতি হিসেবে তাদের যে পরিচয় গড়ে উঠেছে, সেখানে ভাষা এবং সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছে প্রধান উপজীব্য। ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে ধর্ম অপ্রয়োজনীয়। ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন, ধর্ম অভিন্ন, তাই বলে ইউরোপ এক রাষ্ট্র বা এক জাতি হয়নি। তারা তো আলাদা আলাদা রাষ্ট্র ও আলাদা নেশন হয়েই টিকে আছে।
এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি, সেখানে সবার প্রধান ধর্ম ইসলাম। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রগুলোও তারা আলাদা রেখে দিয়েছে। ধর্মভিত্তিক একক রাষ্ট্র হল না । ধর্ম যদি রাষ্ট্রধর্মই হবে তবে ধর্ম কেন একক রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না। তার মুখ্য কারণ নিশ্চয় ভাষা ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র। ইউরোপের সবথেকে অগ্রসর ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূতিকাগার ব্রিটেনের ব্রেক্সিট সংকটে ধর্ম ভূমিকা রাখছে না। এই ধরণের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমাদেরেক মিল–অমিল চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে যাত্রা করতে হবে।
ধর্মের বীজ বপন করেই ব্রিটেন বাংলা ভাগ করল। আমরা সেটা ধারণ করলাম। আমরাতো বঙ্গভঙ্গ রদ করতেও পারতাম । আমরা কেন ভারতের স্বাধীনতার সময় বলতে পারলাম না, বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে থাকবে। ব্রিটিশদেরকেই দুষব নাকি বিভক্তির জন্য আমাদের ভেতরকার গলদগুলো চিহ্নিত করব। কারণ আজকের উপমহাদেশীয় বাস্তবতা, এই সম্মেলন প্রমাণ করছে যে, আমরা এসব থেকে পালিয়ে বাঁচব না।
চীনে অসংখ্য বিশ্বাসের জায়গা থেকে তারা ঐক্যবদ্ধ আছে। ৫৬টি সম্প্রদায় শুধুমাত্র ভাষা ও কালচার দ্বারা 'আলাদা' পরিচয়ে শান্তিতে বসবাস করছে। তাদের খাদ্যাভ্যাসও মোটামুটি অভিন্ন। আমরা ১৯৪৭ সালের পরে এখন দৃঢ়তার সঙ্গে একসুরে বলতে পারি, দেশভাগ ভারতবর্ষের কোথাও কোনোভাবে জাতিভেদ সমস্যার সমাধান দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গে তো মোটেই হয়নি। বরং দেশভাগ জাতিভেদের সমস্যাকে আরো তীব্র করেছে।
বহুসংখ্যক জাতি বা রেস নিয়ে গঠিত ভারতবর্ষে ধর্মের নামে কিছু মানুষকে দুই পাকিস্তানে (পূর্ব ও পশ্চিম ঠেলে দেওয়ার নাম দেশভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জাতিধর্ম নির্বিশেষে কিন্তু ভারতেই থেকে গেল। আমরা বিবেচনায় নেব যে, পাকিস্তান যখন জন্ম নিল, তখন উর্দু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল শুধু সাত ভাগ।
ব্রিটিশরা ডিভাইড এন্ড রুল করেছিল, সেটা চিহ্নিত করব। কিন্তু আজ সময় এসেছে, এটা চিহ্নিত ও প্রতিকারের উপায় বের করা, আমরা করবটা কী। কীভাবে অগ্রসর হব। আমরা কি ব্রিটিশদের বা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দায়ী করতে করতে নিজেরাই বিভাজনের সলতেয় জ্বালানি সরবরাহ করে চলছি কিনা।
আমাদের কি আর সন্দেহ আছে যে, জাতিভেদের সমস্যাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের ভেতর থেকে। আর সেটাই চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল ১৯৪৭ সালে দেশভাগে।
বর্তমান বাংলাদেশের জাতিভেদ প্রথার স্বরূপ উদঘাটনে প্রশ্ন হল জাতির সংজ্ঞা কী। জাতি বা রেসের সংজ্ঞায় ধর্ম পড়ে না । ভাষা এবং কালচার পড়ে। বাঙালি একক রেস বা জাতি হতেই পারছে না । বাঙালি আসলে কখনোই সম্পূর্ণ জাতি হয়ে ওঠেনি এবং কখনো হতে পারবে না , যতক্ষণ ধর্ম ঘাড়ের উপর চেপে বসে থাকবে।
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের জাতি– বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো ভাষা ও সংস্কৃতি । তবে ডাইলেক্ট আলাদা। কলকাতা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, ফেনী, সিলেট, চাটগাঁইয়া ইত্যাদিতে বৈচিত্র আছে, কিন্তু বিভাজন নেই। প্রমিত বাংলা অভিন্ন। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এই যে বিভিন্নভাবে কথা বলে কিন্তু তাদের মূল ভাষা এবং সাংস্কৃতিক শেকড় অভিন্ন। সংস্কৃতি বলতে আমি বুঝি খাদ্য, বুঝি নবান্নের উৎসব। অন্যান্য উৎসব কিংবা রিচুয়াল। বিবাহ দেখুন। হিন্দু–মুসলিম উভয়ের বিয়েতে হলুদের ব্যবস্থা আছে। উভয় সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে গানবাজনার ব্যবস্থা আছে । এটাই বাঙালি সংস্কৃতি। মধ্যপ্রাচ্যের বিবাহ অনুষ্ঠানে একটা জনপ্রিয় বিষয় হলো উলুধ্বনি। বাংলার মূল সংস্কৃতিতে উলুধ্বনি একটি অনুষঙ্গ। মুসলিম বাঙালি কোথাও উলুধ্বনি না দিলে যে তথাকথিত বিভাজন তৈরি হয়, তা দিয়ে আলাদা জাতিরাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিভূমি সৃষ্টি হয় না।
এসব অঞ্চলে জাতীয় সংখ্যালঘুরা নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টিতে একটা বাধা হলো, তারা জাতি হতে পারেনি । তারা অসম্পূর্ণ । তার কারণ ধর্ম দিয়ে তাকে বিভক্ত করা হয়েছে । অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও আমরা বিভাজন রেখা তৈরি করেছি। যেমন চাকমাদেরকে বলা হয়ে থাকে হিন্দু । কিন্তু তারা কি হিন্দু ? তারা পূজা করে বলে তাদেরকে হিন্দু বলে। কিন্তু তার সঙ্গে বাংলার হিন্দুত্ববাদের কোন মিল নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা চাকমা সাঁওতালদের হিন্দু বলে। অথচ হিন্দু রিচুয়ালিটির সঙ্গে তাদের কোনো মিল নেই।
জাতীয় সংখ্যালঘুদের চীন যেভাবে নির্দিষ্ট করেছে, জাতির সংজ্ঞা থেকেই জাতীয় সংখ্যালঘু নির্ধারণ করতে হবে । যেহেতু ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে তাই সাঁওতালদেরকে কেন আমরা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেই না? সাঁওতাল, চাকমাদের তো নিজেদের স্বতন্ত্র ডায়লেক্ট রয়েছে । তাদের বর্ণমালা রয়েছে । কিন্তু আমরা তাদেরকে সেটা চর্চা করার, সেটা বিকাশের সুযোগ দেইনি । কিন্তু প্রত্যেকটা ভাষাগত জাতিগত সংখ্যালঘুকে ইউরোপ এমনকি চীনও অধিকার দিয়েছে।
এর গুরুত্ব আমরা বাংলাদেশের বাঙ্গালিরা বুঝিনি বলেই আমরা কতিপয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের ১৯৭২ সালেই বলেছি , তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর ভুল থেকে আমরা শিক্ষা নেই না। তার নমুনা হলো ২০১১ সালে আমরা সংবিধান সংশোধন করে আবার তার ৬ অনুচ্ছেদে বলেছি, 'বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙ্গালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলে পরিচিত হবেন।' এতে বিভ্রমটা থেকেই গেল।
এটা শাসকদের স্ববিরোধীতা ও সংঘাতের ধ্রুপদী উদাহরণ বটে। তার মানে রাজনীতিকে মানুষের উপরে স্থান দিয়ে মানবতার মর্যাদা ধূলায় লুটাতেই হবে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, তাই তার একটা তকমা লাগবে। অনেকগুলো জাতিকে যেন একটি রাষ্ট্র ধারণ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের ভেতরে বহু জাতি বাস করলেও তার ওপর চাপানো হলো প্রধানত মুসলিম 'বাঙ্গালি' জাতির পরিচয়। এটা কৃত্রিম, বিভ্রান্তিকর এবং ভীষণরকম অপ্রয়োজনীয়। এই জাতির সংজ্ঞায় চাকমা, সাওতালরা নিজেদের খাপ খাওয়াতে আগেও পারেনি। এখনো পারছে না। বাংলাদেশে যারা 'জাতি', তারা এখন 'ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীতসুধা পানে, আমাদের আদিখ্যেতার অন্ত নেই। কিন্তু তাকে রাষ্ট্রনায়ক ভাবতে কেন আমাদের দ্বিধা, সেটা কি তিনি রাষ্ট্রনায়ক নন, সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি বলেই, নাকি, তিনি যা বলে গেছেন, সেটা মেনে নিলে আমাদের দর্প চূর্ণ হয় বলেই।
আমরা 'নেশন' শব্দের বাংলা তরজমাটা সম্ভবত জবরদস্তি করেছি। যাতে সংখাগরিষ্ঠের আগ্রাসনের স্বরূপ ঢেকে রাখা যায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে সংখালঘুদের অবদমিত রাখা যায়। রাষ্ট্রীয় সীমানায় থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের অধিকারকে খর্ব করা যায়। সুতরাং আসুন রেস অর্থে জাতি বুঝি। মেনে নেই, নেশনের বাংলা জাতি নয়।
ইউরোপে পূনর্জাগরণ হয়েছিল। কিসের পুনর্জাগরণ হয়েছিল? পুনর্জাগরণ বা রেনেসাঁ কিভাবে সেখানে ধর্মকে ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিয়েছে ।
আজ ভারতীয় মহাদেশে মানবতার বিজয়কেতন ওড়াতে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম নিয়ন্ত্রণ বা ধর্মের নামে যা কিছু মানবিক মর্যাদাকে খাটো করে তাকে মোকাবেলা করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। ইসলামের মহানবীর এই মূলমন্ত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। ইসলাম ধর্মের ভিত্তি যে ব্যক্তিকে ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে আলাদাকরণ, তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হিন্দুত্ববাদকে যখনই যে দল বা গোষ্ঠী, বিভাজনের দেয়াল তোলার কাজে ব্যবহার করবে, তাকে শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবেলা করার উপায় বের করতে হবে।
আমাদের বুঝতে হবে, গোটা ভারতবর্ষে বাঙ্গালিদের কি সম্ভাবনা ও সংকট ছিল, যা ধর্মের ভিত্তিতে শুধু এই ভূখন্ডে বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য করল। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই লর্ড কার্জন ট্রেনে বসে তৎকালীন ভারত সেক্রেটারিকে লিখেছিলেন, বাংলাভাগ না হলে আমরা পেরে উঠব না। পরের ৪২ বছরের আয়ুষ্কাল কি বঙ্গভঙ্গ দিয়েছিল, কতোটা, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। উপসংহার টানতে শরনাপন্ন হবো রবীঠাকুরের। বাংলাভাগের তিন বছর পরে ১৯০৮ সালে তিনি বলেছিলেন, 'যতোদিন আমি বেঁচে থাকি, ততোদিন আমি মানবতার ওপরে দেশপ্রেমকে জয়ী হতে দেব না।'
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক