রোববার নির্বাচন: কে হতে যাচ্ছেন মের্কেল-পরবর্তী জার্মানির চ্যান্সেলর?
জার্মানিতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামীকাল ২৬ সেপ্টেম্বর, ঘড়ির কাঁটায় সময়ের হিসাব কষলে বাকি আছে আর মাত্র ১ দিন। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন মানেই একধরনের আমেজ-উত্তেজনার প্রতিচ্ছবি, জার্মানিও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম নয়। তবে জার্মানিতে এবারের নির্বাচনে যা ব্যতিক্রম তা হচ্ছে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের ২০০৫ থেকে ২০২১ অবধি টানা চার মেয়াদে নেতৃত্বে থাকার পর স্বেচ্ছায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো। ২০১৭ সালে বুন্দেস্টাগের ভোটে অবনমন এরপর ২০১৮ তে ব্যাভেরিয়ার প্রাদেশিক নির্বাচনে তার জোটের ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি এই ঘোষণা দেন, এটাও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য; অনেক জার্মানই যা মেনে নিতে পারছেন না এখনও।
তবে মের্কেলবিহীন এই নির্বাচন অনেক কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানত, ইউরোপের বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানির গোটা ইউরোপ জুড়ে যে সফট হেজেমনিক অবস্থান, তার কী হবে? এরপর আসে মের্কেল ঠিক যে কারণে জনপ্রিয়, সেই বৃহত্তর স্বার্থে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নতুন নেতৃত্ব কতটা অব্যাহত রাখতে পারবে। সবশেষে যে প্রসঙ্গ আসে, তা হলো অভিবাসন সমস্যা। আগামী কয়েকবছরের মধ্যে এটাই হবে জার্মান রাজনীতির মূল ইস্যু। শরণার্থীদের বিষয়ে মের্কেলের যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা কতটা টিকে থাকবে সামনের দিনে সেটাও চিন্তার বিষয়। বলা বাহুল্য, জার্মানিতে হিটলারের পর আবার কট্টর দক্ষিণপন্থীদের সমসাময়িক উত্থান কিন্তু এই শরণার্থী সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যার বলি হয়েছেন মের্কেল নিজেই। তবে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতেই কিন্তু শরণার্থীদের প্রয়োজন, সেটা জার্মান নীতিনির্ধারকেরা ভালো করেই জানেন। আর সবকিছু নির্ভর করছে ২৬ তারিখের নির্বাচনের ফলাফলে কারা ভালো করবে, তার উপর।
শরণার্থীদের বিষয়ে মের্কেলের যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা কতটা টিকে থাকবে সামনের দিনে সেটাও চিন্তার বিষয়। বলা বাহুল্য, জার্মানিতে হিটলারের পর আবার কট্টর দক্ষিণপন্থীদের সমসাময়িক উত্থান কিন্তু এই শরণার্থী সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যার বলি হয়েছেন মের্কেল নিজেই। তবে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতেই কিন্তু শরণার্থীদের প্রয়োজন, সেটা জার্মান নীতিনির্ধারকেরা ভালো করেই জানেন।
জার্মানিতে এবারের ২০তম সংসদ নির্বাচনে মোট ছয় কোটি চার লাখ ভোটার ভোট দেবেন ৫৯৮ জন সংসদ সদস্য বেছে নেওয়ার জন্য। তবে নির্বাচন ব্রিটিশ মডেলের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে হয়ে থাকে। দুইকক্ষ বিশিষ্ট সংসদে সাধারণ ভোটাররা ভোট দেন শুধু নিম্নকক্ষ বুন্দেস্টাগ এর জন্য, প্রত্যেক ভোটারকে আবার ২ উপায়ে সাংসদ নির্বাচিত করতে হয়, প্রথম ভোটে ২৯৯ জন সাংসদ নিজ নিজ এলাকা থেকে নির্বাচিত হন, ২য় ভোটটি দিতে হয় যেকোনো একটি দলকে। মোট ভোটের সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ পাওয়া দলগুলো থেকে হার অনুযায়ী বাকি ২৯৯ আসন বন্টন করা হয় এতে ব্যক্তির বাইরে দলগুলোর অবস্থানও নির্ধারণ হয়ে যায়।
প্রথা ভেঙে এবারের নির্বাচনে চ্যান্সেলর হওয়ার দৌড়ে আছেন তিনজন, যেটা সাধারণত গত কয়েক নির্বাচনে দুইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। মের্কেলের ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন(সিডিইউ) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নর্থ রাইন-ওয়েস্টফ্যালিয়ার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আরমিন লাশেট, যিনি একইসাথে সিডিইউর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) থেকে লড়ছেন জার্মানির বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর ও অর্থমন্ত্রী ওলাফ শলৎস। আর পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি থেকে আছেন দলটির প্রধান ও একমাত্র নারী প্রার্থী আনালেনা বেয়ারবক।
তিনজনের মধ্যে হয়ে যাওয়া সর্বশেষ টিভি বির্তকের ফল বলছে চ্যান্সেলর হওয়ার দৌড়ে ভালোভাবেই এগিয়ে আছেন শলৎস। জরিপে অংশ নেওয়া দর্শকদের ৪১ শতাংশ এগিয়ে রাখছেন শলৎসকে, ২৭ শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন লাশেটে অপরদিকে ২৫ শতাংশ ভোট দিয়েছে বেয়ারবককে।
দলীয় বিবেচনায় গ্রিন পার্টি ভাল অবস্থানে থাকলেও তাদের প্রার্থীর চ্যান্সেলর হওয়ার মতো ইমেজ যে এখনও গড়ে ওঠেনি, তা জরিপের ফলে মোটামুটি পরিষ্কার। বাকি থাকেন শলৎস আর লাশেট, যাদের দুজনই আবার অভিজ্ঞতা আর ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে আছেন। তবে জরিপের ফলে এগিয়ে এসপিডির শোলৎসই। বলা হচ্ছে সিডিইউ এর অবস্থান কোনো সময়েই এত খারাপ ছিল না, দলের ব্যর্থতার পাশাপাশি নিজ রাজ্যে লাশেটের করোনা মোকাবেলায় নেওয়া পদক্ষেপ নিয়ে সৃষ্ট জন অসন্তোষকেও এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আটলান্টিকের দুই তীরে জেরোমি করবিন, বার্নি স্যান্ডার্সরা না পারলেও কার্ল মার্ক্সের দেশেই এবার সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা জয়োল্লাসে মাতবে।
তবে জার্মানদের নির্বাচন ব্যবস্থা বলছে, ব্যক্তির ইমেজের পাশাপাশি দলের সাফল্যও মুখ্য জেতার জন্য। এই মুহুর্তে বার্লিনে কারা সরকার গঠনের টক্করে সামনের কাতারে আছে বুঝার জন্য জার্মানির ছোট-বড় ৬ টি রাজনৈতিক দলের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। ২০১৭ এর নির্বাচনে দলগুলোর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন-ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (আঞ্চলিক) জোট পেয়েছিলো মোট ভোটের ৩২.৯ ভাগ , সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ২০.৫ ভাগ, অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) ১২.৬ ভাগ, ফ্রি ডেমোক্র্যাটস (এফডিপি) ১০.৭ ভাগ, লিংক (বাম) ৯.২ এবং গ্রিন পার্টি ৮.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
পরিসংখ্যান বলছে, কোনো দলেরই এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ বরং কোয়ালিশন সরকার হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। এক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, যারাই জোট করুক না কেন, সিডিইউ বা এসপিডিকে বাইরে রেখে কোনো জোটই হবে না। আবার এই জোট গঠনে গ্রিন, ফ্রি ডেমোক্র্যাটস আর লিংকের মতো ছোট দলের গুরুত্বও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গতবার সিডিইউ-এসপিডি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। এবারের জরিপে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়; যথাক্রমে ২৪% ও ১৮% ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের। জার্মানরা যে এই দুই ঐতিহ্যবাহী দল থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তার প্রমাণ গ্রিন পার্টি আর এএফডির উত্থান, পরিবেশ বিপর্যয়ের ধারণা পুরো ইউরোপে যে পরিমাণ সাড়া ফেলেছে তার ছোঁয়া এখানেও লেগেছে, জরিপ বলছে এবার তারা ২২% পর্যন্ত ভোট বাগিয়ে নিতে পারে। অপরদিকে এএফডির জন্ম ২০১৩ তে হলেও বর্তমান সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দল। কট্টর দক্ষিণপন্থী দলটি তুমুল শরণার্থী বিরোধী প্রচারণা চলিয়ে দ্রুত এত উপরে উঠে এসেছে, এবার তারা ক্ষমতায় আসতে না পারলেও, সামনের দিনগুলোতে এই ধারার রাজনীতি যে মুখ্য হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।
পরিসংখ্যান বলছে, কোনো দলেরই এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ বরং কোয়ালিশন সরকার হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। এক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, যারাই জোট করুক না কেন, সিডিইউ বা এসপিডিকে বাইরে রেখে কোনো জোটই হবে না। আবার এই জোট গঠনে গ্রিন, ফ্রি ডেমোক্র্যাটস আর লিংকের মতো ছোট দলের গুরুত্বও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ঘুরে-ফিরে শোলৎস বা লাশেটই যে বার্লিনের মসনদে বসছেন তা এক প্রকার নিশ্চিতই বলা যায়।
ক্ষমতায় কেউ একজন তো আসছে নিশ্চিত। তবে হেলমুট কোল, মের্কেল পরবর্তী জামানায় ব্রাসেলসে ছড়ি ঘোরানোর নিশ্চয়তা যে ঘোর অনিশ্চিত সেটাই বোধ করি জার্মানদের জন্য জরুরি বিষয়। ইইউর ক্রাইসিস ম্যানেজার মের্কেলের তৎপরতায় ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এতদিন চুপচাপ থাকলেও এবার সুযোগ তার হাতে ইইউকে নেতৃত্ব দেওয়ার। তবে দিনশেষে জার্মান অর্থনীতির শক্তি ছাড়া তিনি কতদূরই বা আর যাবেন?
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।