সন্ত্রাসবাদের দেশ পাকিস্তান যখন অন্যদের দোষারোপ করে
পাকিস্তানের সেনা সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাদের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা খুবই খণ্ডিত। ইমরান খান তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে দেশটির দুর্ভাগ্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, আফগান-তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজ দেশের জড়িয়ে পড়ার কথা।
ইমরান খান হয়তো ভুলে গেছেন, তার দেশ জন্মলগ্ন থেকেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সামরিক শাসন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। দেশটির ইতিহাস বলে, এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সামরিক বাহিনী নানাভাবে যুদ্ধে জড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যার্থতা ঢেকে তাই নিজের বক্তব্যে ইমরান খান কেবলমাত্র আফগান যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে নিজেদের সামরিক বাহিনী ব্যর্থতা আড়াল করতে চাচ্ছেন।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহৎ সামরিক বাহিনী। সামরিক বাহিনীর ব্যয় তাদের জাতীয় আয়ের কতটা, তা কোনোভাবেই প্রকাশ করা হয় না। ঠিক জানা যায় না যে, তারা কত টাকা ব্যয় করে তাদের এই সামরিক খাতে। তবে যে সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তাও আশঙ্কাজনক। জাতীয় আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশের উপরে শুধু সামরিক খাতে ব্যয় করা হয় বলেও তথ্য আছে। যদিও সে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়।
দেশটির জন্মকাল থেকে শুরু করে সমাজ গঠন, রাষ্ট্র গঠন কখনো সামনে আসেনি। দেশটিতে ধারাবাহিকভাবে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থেকে কখনো সরাসরি, অথবা পর্দার পেছনে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে- যে ধারা এখনো অব্যাহত। ইমরান খানের নির্বাচনে বিজয় তেমনি একটি ঘটনা, যার ফলে নওয়াজ শরিফকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
ইমরান খান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছেন। দেশটির জন্মের ৮-৯ বছরের মাথায় প্রথম সামরিক শাসন জারি করেন জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুব খানের সাড়ে ১০ বছর শাসনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আড়াই বছর, জেনারেল জিয়াউল হকের ১০ বছর, জেনারেল মোশাররফের ১১ বছর।
দেশটি ৩৫ বছর সামরিক শাসকদের আওতায় ছিল। সেই বিবেচনায় পাকিস্তান থেকে ২৩ বছরের মাথায় আলাদা হয়ে যাওয়া নতুন দেশ আমাদের বাংলাদেশে অনেকটা এগিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে মোট ৮ এবং বেসামরিক শাসনের অন্তরালে ২ সর্বমোট ১০ বছর সামরিক শাসনের আওতায় পড়েছি আমরা। পাকিস্তানের জাতির জন্মকাল থেকেই সামরিক বাহিনীর প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তেই কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ ঘটে। সেই ১৯৪৭ সালের পরেই ব্রিটিশ উত্তরাধিকারের মাধ্যমে সৃষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেপ্টেম্বর মাসেই কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে। সেই থেকেই চলছে কাশ্মীরকে নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধ। যে বিরোধে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে গণহত্যার অভিযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
আজও কাশ্মীরের ভেতরের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানের ১৯৪৭ পরের সেই গণহত্যার কথা। পাকিস্তানের সেনা নায়ক জেনারেল আইয়ুব খান প্রথমে ক্ষমতায় আসেন ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে। এর পর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ। আড়াই বছরের ক্ষমতায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে দ্বিখণ্ডিত করেন এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণহত্যা চালান। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। পাকিস্তান ভেঙ্গে জন্ম হয় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের।
যদি আফগান মাটিতে যুদ্ধের কথা বলি, তাহলে পাকিস্তানই বিন লাদেনের জন্ম দিয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সোভিয়েতের আফগান দখলদারিত্বের পরবর্তী সেই সময়ও মার্কিনিরা পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে আফগানিস্থানে বিন লাদেনকে সমর্থন জুগিয়েছে; অস্ত্র এবং অর্থায়ন করেছে। বিন লাদেন তখন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছিলেন মুজাহিদের নেতা হিসেবে। তখনকার পশ্চিমা গণমাধ্যম বিন লাদেনকে আখ্যায়িত করেছে মুজাহিদের নেতা হিসেবে। সেই আফগান যুদ্ধে মুজাহিদীনদের বিজয় অর্জন হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। তারা সৈন্য প্রত্যাহারের পর থেকে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার কায়েম হয়েছিল। সেই তালেবান সরকারের অধীনেই বিন লাদেন তার পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে টুইন টাওয়ার আক্রমণ করেছিলেন এবং বিন লাদেনের জীবনাবসান ঘটেছে পাকিস্তানের মাটিতে। সেখানেই আমেরিকান কমান্ডো অভিযান চালিয়ে বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে।
ইমরান খান সামরিক বাহিনীর লোক হিসেবে ক্ষমতায় আছেন এবং পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দল তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের আন্দোলনে লিপ্ত। কিন্তু সে আন্দোলন জোরালো হতে পারছে না সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের ওপর থাকায়।
পাকিস্তানের অবস্থান দেশটিকে আরেকটি মারাত্মক জনযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যাবে, খুব নিকট ভবিষ্যতেই আরেকটি সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার সম্ভাবনা। যদিও ইতোমধ্যেই বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ফলে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন ভয়ঙ্কর রকমের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে।
ওই রায়ে পাকিস্তানে ২০০২ সালে নিহত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার দায়ে দণ্ডিত সন্ত্রাসী নেতা ওমর সাইদ শেখ মুক্তির আদেশ প্রদান করেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। এই ধরনের আদেশ বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে এক নতুন আস্থাহীনতা সৃষ্টি করল।
এর আগেও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নানাভাবে নিজেদের বিতর্কিত করেছেন। পৃথিবীতে ফেডারেল কাঠামোর ২৩টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্থা অনেকভাবে একটি প্রভাবিত বিচার ব্যবস্থা। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেন তালেবান যুদ্ধে পাকিস্তানকে জড়ানোর দায়বদ্ধতার জন্য, তা মানুষের কাছে হাসির উদ্রেক ঘটায়। যারা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন, এই পাকিস্তান নামক দেশটির সমাজ কতভাবে বিভক্ত, কীভাবে তারা ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের কাছে জিম্মি। ওমর শেখের ওই কারামুক্তি তারই একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
আজও দেশটি বাংলাদেশে গণহত্যার দায় স্বীকার করেনি। দেশটির অভ্যন্তরীণ সামাজিক সমাজ গঠিত হয়নি। এতেই প্রমাণ হয়, ওই সমাজের গুণগত অবস্থান কোথায়।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক