সভ্যতা-কেন্দ্রিক বিশ্বের আলোচনায় ক্যানজুক
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর (ব্রেক্সিট) বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বলয়ে আপাতত একা হয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যকে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন ইংরেজি ভাষাভাষী কয়েকটি দেশ নিয়ে একটি জোট গঠন করার। প্রস্তাবিত সেই জোটের নাম হল- ক্যানজুক। ক্যানজুক(CANZUK) শব্দটি মূলত এই প্রস্তাবিত জোটের সদস্য দেশগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত রূপ; কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যন্ড এবং যুক্তরাজ্য।
আন্তর্জাতিক এই জোটের সদস্যরা নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে একটি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্প্রদায় গঠন করবে। আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে চলে যাওয়ায় যুক্তরাজ্য এখন থেকে তার নিজস্ব বাণিজ্য-চুক্তি সম্পাদন এবং পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে পারবে।
ভৌগোলিকভাবে আঞ্চলিক বিন্যাস বা নৈকট্য নয়, বরং সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত কারণে এ জোটকে সম্ভব করে তোলে। এমন এক সময় যখন বিশ্ব ক্রমাগত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, সেসময় ব্রিটিশ নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতারা অনুপ্রেরণার জন্য অতীতের যে দিকে তাকিয়ে আছেন তার ফলাফলটি হলো ক্যানজুক। ব্রেক্সিট-পরবর্তী নীতিমালা এবং নতুন শতাব্দীর সভ্যতা-সংক্রান্ত প্রশ্নে এই পরিকল্পনার আলোচনা ভিত্তি পাচ্ছে। ক্যানজুকের সম্মিলিত অর্থনৈতিক কূটনৈতিক এবং সামরিক সামর্থ্য ফলে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ 'সুপার-স্টেট' এর আবির্ভাব হবে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়, ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকরা ক্রমান্বয়ে পতনের মুখে একটি বিশাল সম্রাজ্য নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি ছিলেন। ১৮৩০-এর দশকের বিদ্রোহের পরে কানাডায় স্ব-শাসন মেনে নিতে বাধ্য হওয়ার পর ওয়েস্ট-মিনিস্টারে চিরস্থায়ী সাম্রাজ্যের আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তে উপনিবেশবাদের পতনের ফিসফিস শুরু হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাজ্যের উপর বাহ্যিক চাপও নীতিনির্ধারকদের জীবন অসহনীয় করে তুলছিলো। দ্রুত বিকাশমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে উত্তর আমেরিকার বাজার দখল করায়, যুক্তরাজ্যের অংশীদারিত্ব বাস্তুচ্যুত হচ্ছিলো। ইউরোপে উদীয়মান, সম্প্রসারণবাদী জার্মানি আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিলো। আবার সম্রাজ্যের ভেতরে আফ্রিকা ও এশিয়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ক্রমাগত ব্রিটিশ শাসনের যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলো। সুতরাং যে সাম্রাজ্যের 'কখনও সূর্য অস্ত যেতো না', তার চারপাশে কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠে। তাই নীতিনির্ধারকরা সেই সময় সম্রাজ্যের বিকল্প 'ফেডারেশন' বিবেচনা করেছিলেন।
এই প্রস্তাবনায় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড (বর্তমান কানাডার পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রদেশ) এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শ্বেতাঙ্গকেন্দ্রিক দেশের সমন্বয়ে একটি ফেডারেল ইউনিয়ন দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিস্থাপনের আলাপ তুলেছিলো। ফেডারেল সংসদ দিয়ে পুরো ফেডারেশন জুড়ে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি সমন্বয় করবে। সম্রাজ্যের বোঝা ঝেড়ে ফেললেও, এ রাজনৈতিক ধারণাটি প্রতিদ্বন্দ্বীপূর্ণ স্বার্থের অংশীদারদের দিয়ে গড়ে ওঠা অ্যাংলোস্ফেয়ার সভ্যতার উপর দাঁড়ায়।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতিনির্ধারকদের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং শেষ পর্যন্ত আকর্ষণ হারিয়েছিলো। পরবর্তী শতাব্দীতে সভ্যতাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে জাতিরাষ্ট্রসমূহের আধিপত্য শুরু হয়। মানুষের যেকোন চিন্তা সবসময় অমর, তা সময় ও কাল পরিবর্তনে এবং বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে ফিরে আসে। নীতি, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে বহুজাতিক সভ্যতাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণা এখন আবারও বৈশ্বিক রাজনীতির সম্মুখে চলে এসেছে। চীন, রাশিয়া, ভারত এবং তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের সভ্যতার পরিচয়কে জোর দিচ্ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক অংশে তাদের সভ্যতার পরিচয় অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছে। সুতরাং উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী যদি জাতিরাষ্ট্রের হয়, তাহলে একাবিংশ শতাব্দী সেই জায়গা থেকে সরে এসে সভ্যতা-ভিত্তিক রাষ্ট্রের হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল।
সেই আলোচনা থেকেই ক্যানজুক, নতুনরূপে আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে অংশীদার কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিট-পরবর্তী বিশ্বে রাজনৈতিক আলোচনায় নবদ্বার উম্মোচন করেছে। লন্ডন এই সুযোগে একই সাথে তার পূর্ববর্তী ডোমিনিয়নগুলোর সঙ্গে নতুনভাবে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের উপলক্ষ বের করার সুযোগ পাবে। ক্যানজুকের সংজ্ঞা বা তার বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা কিংবা কর্তৃত্বের আলোচনায় রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা নিয়ে বিতর্কের বিষয় থাকলেও, মোটাদাগে এটি একটি অবাধ চলাচল ও মুক্তবাণিজ্যের অর্থনীতির জন্য একটি প্রস্তাবিত জোট।
ক্যানজুকের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কেউই প্রতিরক্ষা জোট বা একীভূত বিচারব্যবস্থা গঠনের কথা বলছে না এবং কোন একক আইনসভা গঠন করে সার্বভৌমত্বের সাথে কোনরকম সমঝোতায় যেতে আগ্রহী তো নয়ই। সুতরাং ক্যানজুক হলো অ্যাংলোস্পিয়ার দেশগুলোর একটি দুর্বল জোট যার প্রায় ১৪ কোটি জনসংখ্যার অর্থনীতি জিডিপির পরিমাপে দাঁড়ায় প্রায় ৬ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ক্যানজুক গঠন হলে তাৎক্ষণিকভাবে একটি অর্থনৈতিক এবং সামরিক পাওয়ার হাউসে পরিণত হবে। আয়তনে তা হবে পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ, এবং জনসংখ্যা ও কূটনৈতিক ওজনে সদস্য দেশগুলোকে বিশ্বরাজনীতিতে নতুন ক্ষমতা প্রদর্শনের নতুন ক্ষেত্র তৈরী করে দিবে। খাতা-কলমে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন এর মতো শক্তিধর দেশের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ক্যানজুক।
নিজেদের মধ্যে ঐতিহ্যগত মিলই হচ্ছে ক্যানজুকের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। এমনকি সেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এখনও দায়িত্ব পালন করে থাকেন এবং তারা সবাই কমন ল'(Common Law) আইনি ব্যবস্থার অনুসরণ করে। গোয়েন্দা পর্যায় বা সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স এর ক্ষেত্রেও চারটি দেশই ফাইভ আইস্ (Five Eyes) এলায়েন্সের অংশ, যার অপর সদস্য হলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রকাশ্যে কূটনীতিতেও ক্যানজুক সদস্যরা বিংশ শতকের সকল সংঘর্ষে একসঙ্গে, একপক্ষে অংশগ্রহণ করেছে এবং বরাবর একই পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে।
বিভিন্নক্ষেত্রে ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সম্পর্কে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে; যেমন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রান্স-তাসমান ট্রাভেল এ্যারেঞ্জমেন্ট এবং বাণিজ্যে ক্লোজার ইকোনমিক রিলেশন্স ট্রেড এরেঞ্জমেন্ট এর ফলে চলাচলের স্বাধীনতার মাধ্যমে শ্রম, পণ্য ও সেবা খুবই সহজেই বিনিময় করা সম্ভব হয়। যদিও নিরাপত্তার জন্য অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে নিয়মাবলী সময়ে-সময়ে পরিবর্তিত বা সংশোধিত হয়েছে। এই দুটি চুক্তি ক্যানজুক এর কাঠামো নির্মাণের পরিপূরক হিসেবে যথেষ্ট, অতিরিক্ত কিছু বিধান সংযুক্ত করে যুক্তরাজ্য এবং কানাডাকে অন্তর্ভুক্ত করে ক্যানজুকের কাঠামো নির্মাণ করা যায় খুব সহজে। এই ব্যবস্থার ফলে এসব দেশের নাগরিকরা যারা ইতিমধ্যেই অস্থায়ী অভিবাসী হিসেব অন্য সদস্য দেশে বসবাস করে আসছেন, তাদের পারস্পরিক নাগরিকত্বের সুবিধায় এনে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে ক্যানজুকভুক্ত দেশগুলো প্রায় ৭ কোটি জনগনের বিশাল শ্রমবাজারের সুবিধা ভোগ করবে।
তবে প্রস্তাবনার সমালোচকদের মতে, একীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া ৬ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের জিডিপি কোন বাস্তব ফলাফল আনবে না। অর্থবহ একক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা না থাকলে ক্যানজুকের সদস্যরা নিজেদের সম্পদ সংহত করতে অক্ষম হবে, ফলে এ সংস্থা কেবল কাগুজে বাঘ হিসেবেই টিকে থাকবে।
ক্যানজুক সফল হতে হলে একটি একক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা আবশ্যক। প্রতিটি সদস্য-রাষ্ট্রকে সম্মিলিত সুবিধার জন্য নিজেদের সার্বভৌমত্ব কিছুটা ত্যাগ করতে হবে, যা মোটেও সহজ হবে না কারণ চারটি দেশের পৃথক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে। একে অপর থেকে হাজার-হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যানজুক সদস্য দেশগুলো পরস্পরের সাথে অল্প পরিমাণে বাণিজ্য করে। উদাহরণ স্বরূপ, প্রতিবেশী বা নিকটস্থ গন্তব্যে রফতানির হিসেবে ব্রিটিশ রফতানির পরিমাণ ৪৪%, কানাডিয়ান রফতানির পরিমাণ ৭৭% এবং অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড উভয়ের রফতানির পরিমাণ ৪০%। পক্ষান্তরে, অন্যান্য ক্যানজুক সদস্যের সাথে বাণিজ্য অস্ট্রেলিয়ার রফতানির মাত্র ৫% এবং কানাডা এবং যুক্তরাজ্য উভয়ের রফতানির ৩%। তার অর্থ, চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়া তার বেশিরভাগ বাণিজ্য সম্পন্ন করে, নিউজিল্যান্ডের বেশিরভাগ বাণিজ্য অস্ট্রেলিয়ার সাথে এবং কানাডা অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর। এই ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা রাতারাতি পরিবর্তিত হবে না এবং যদি বাণিজ্যের পুনর্গঠন করতে হয় তাহলে তা ব্যয়বহুল হবে। প্রতিবেশীকুল অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যের কারণেই চারটি দেশ সম্পদশালী হয়েছে এবং বাণিজ্যের পুনর্গঠনের ফলে এই সমৃদ্ধির অনেকটাই ব্যাহত হবে। এমনকি ক্যানজুকের সদস্যরা একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনে পরিচালিত হলেও দেশগুলোর স্থানীয় শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
যে অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো সাফল্য আনার চাইতেও অধিক পরিমাণ ক্ষতি নিয়ে আসবে, সেরূপ কোন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই লন্ডন, ক্যানবেরা, অটোয়া কংবা ওয়েলিংটন চাইবে না। ক্যানজুকের সদস্যরা একে অপরের প্রতি যতটাই সাংস্কৃতিক বা স্মৃতিবেদনাকাতুরতায় মগ্ন থাকুক না কেন, তারা অর্থনৈতিকভাবে আঘাতের আশংকায় উদ্বিগ্ন হবে। যদি কোনওভাবে ক্যানজুক একক বাজার ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে অস্তিত্বকে বাণিজ্যের মতো নিশ্চিতরূপে টিকিয়ে রাখতে সম্মিলিত সামরিক সহায়তার নিরাপত্তা জোট আবশ্যক। ভৌগলিক নৈকট্য, সক্ষমতা ইত্যাদি একটি নিরাপত্তা জোট গঠনে অত্যাবশ্যক উপাদান। কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থে বৈসাদৃশ্য দেখা গেলে, যৌথ নিরাপত্তা জোট প্রায়শই অচল হয়ে যায়।
কাগজে-কলমে ক্যানজুক জোটের শক্তিশালী সামরিক শক্তি থাকলেও, বাস্তবে একই সাথে আর্কটিকে শক্তিশালী রাশিয়াকে এবং এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে শক্তিশালী চীনের মুখোমুখি হতে হবে। এই ভৌগলিক ভারসাম্যহীনতা ক্যানজুকের সামরিক শক্তির সক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলায় ক্যানজুকের সম্মিলিত নিরাপত্তা বা সমরনীতি নির্ধারণের জন্য একটি কেন্দ্রিভূত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জন্য স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন। সম্মিলিত সুরক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব অনেকখানি বিসর্জন দিতে হবে। পরিতাপের বিষয় হলো এই জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন ক্যানজুককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতোই অতিপ্রাকৃত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। মূলত এই কারণেই লন্ডনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হওয়া। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার অভাবই হলো ক্যানজুকের প্রধান সীমাবদ্ধতা।
সমন্বয়হীনতার আলোচনায় সবচেয়ে কম আলোকপাত করা হয় যে বিষয়ে এবং ক্যানজুকের সবচেয়ে মৌলিক সীমাবদ্ধতার জায়গাটি হলো চারটি সদস্য দেশের মধ্যে তিনটি দেশ পুরোপুরি অর্থে দ্বীপরাষ্ট্র। টেলিযোগাযোগ, স্বয়ংক্রিয় পণ্যপরিবহন এবং দীর্ঘ রুটের বিমানের মতো আধুনিক প্রযুক্তি মহাসাগরে নির্ভরতার চাপকে কমিয়ে আনলেও; অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের ঋদ্ধি এখনও মহাসাগরের মুক্ত-বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। অবাধ ও বিস্তৃত মহাসাগরীয় বাণিজ্যিক পথ ক্যানজুকের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং নিরাপত্তার স্তম্ভ নিশ্চিত করতে রক্তনালীর মতো কাজ করবে। তা সত্ত্বেও, ক্যানজুক সদস্যদের মহাসাগরে তাদের বাণিজ্যিক যাত্রার সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে নৌ সক্ষমতা নেই।
পরিশেষে যদি কোনও উপায়ে লন্ডন, ক্যানবেরা, অটোয়া এবং ওয়েলিংটন একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট গঠন করতে সক্ষম হয়, তাহলে নবগঠিত জোটটি তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ পরাশক্তির কাছে কৌশলগতভাবে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকবে। মহাসাগরে ওয়াশিংটনের অতুলনীয় সক্ষমতা রয়েছে যার ফলে ক্যানজুকের বাণিজ্য, সামরিক, কৌশলগত, নিরাপত্তাজনিত অগ্রযাত্রা পাশ কেটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং একতরফাভাবে ওয়াশিংটন যেকোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে। অতএব, ক্যানজুকের অস্তিত্ব এমন একটি বিশ্বেই সম্ভব যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধাচারণ করবে না এবং তা স্রেফ ওয়াশিংটনের অনুমোদনেই সম্ভব। উল্টোদিকে ক্যানজুকের বর্ণিত সীমাবদ্ধতাগুলো কেবল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই কাটিয়ে উঠা সম্ভব। অতএব, এই জোটের কৌশলগত কেন্দ্র লন্ডন নয়, বরং ওয়াশিংটনেই অবস্থিত থাকবে।
অ্যাংলোস্ফেয়ার সভ্যতাভিত্তিক ক্যানজুককে পরাশক্তি হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়াতলেই নীতি নির্ধারণ করতে হবে। আবার গণচীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উত্থানে ক্যানজুক যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তম মিত্র হতে পারে।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়