হেফাজতের আন্দোলন এবং আ. লীগ নেতা আমু, তোফায়েলের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আগমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মোদির সফরবিরোধী হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের নেতারা যে সব মন্তব্য করেছেন তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। নেতাদের ভাষ্য মতে: 'তাদের বিষয়ে যতই কৌশল অবলম্বন করা হোক, সনদ দেওয়া হোক আর যেভাবেই খুশি করার চেষ্টা করা হোক তারা তাদের রাজনৈতিক দর্শন থেকে সরে আসবে না। দমন করতে না পারলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সর্ব শক্তি নিয়ে নামতে হবে। আইনি ব্যবস্থা নিয়ে এদের আইনের আওতায় আনতে হবে।'
সোমবার (২৯ মার্চ) স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু বলেছেন, 'মোদির সফরকে তারা (হেফাজতে ইসলাম) অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এর আড়ালে তারা অপ্রকাশ্যে দিবসগুলোক প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। দেশের উন্নয়নের সামনে বিকল্প কিছু না পেয়ে তারা ধর্মান্ধ স্লোগান দিচ্ছে। তবে এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা মনে করি না। তারা সুযোগ পেলেই সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেয়। এই সাম্প্রদায়িকতার স্লোগান পাকিস্তান থেকেই চলে আসছে।'
আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকারি জনাব তোফায়েল আহমেদ ওই আলোচনা সভায় বলেছেন, 'হেফাজতের মধ্যে অধিকাংশই জামায়াতের লোক। মামুনুল হকের বাবা কে ছিলেন? তাদের অন্যরা কারা? আপস করে কখনো লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। রাজনীতিতে আজ যেটা শুরু হয়েছে তা অশনিসংকেত। আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে নামতে হবে। যতই খুশি করার চেষ্টা করি তারা কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দর্শন থেকে সরবে না।'
জনাব তোফায়েল সঠিক ব্যাখ্যাই করেছেন, আর যা-ই করা হোক হেফাজত তার দর্শনের জায়গা থেকে সরবে না, মামুনুল হকের পিতার পরিচিতি তুলে ধরেছেন। এদের পূর্বপুরুষরা সবাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল। ভালো করে যদি তথ্য সংগ্রহ করা হয় দেখা যাবে হেফাজতের প্রায় সব নেতারই পূর্বপুরুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
২০১৩ শাপলা চত্বরের ঘটনা থেকেই হেফাজতের যাত্রা শুরু হয়। হেফাজত সেই সময়ের শাপলা চত্ত্বরে জমায়েত করতে চাইলে সরকারের একটি পক্ষ সমঝোতার পক্ষ নিয়ে হেফাজতকে সেই সমাবেশ করার অনুমতি প্রদান করলে দেশের অধিকাংশ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল সেই সমাবেশকে সমর্থন করে। এদের মধ্যে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং বিএনপিও ছিল। জমায়েত করার ভেতর থেকে সেদিন সরকার বিরোধী অবস্থানই নিয়েছিল হেফাজত। সরকারকে শেষ পর্যন্ত কঠোর হাতে সেই সমাবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল।
হেফাজত কর্মীরা নানানভাবে সেই ঘটনার মিথ্যা বয়ান প্রদান প্রচার করছে। দেশব্যাপী আজও তারা বলে থাকেন সেই সময় তাদের শত শত কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সেই থেকে হেফাজতের বিকাশ পুর্ণ গতিতে চলছে। এখন দেশে হেফাজতি মাদ্রাসার সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক তথ্য জানা যায় না । সব এলাকাতেই মাদ্রাসাগুলোর অর্থয়ান করা হয় স্থানীয় নানান ধারার অসাধু আয়ের মানুষের কাছ থেকে।
দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার জন্য ইসলামের বিকাশের নামে দেশে শত শত মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, গত দুই দিনের ঘটনায় দেশের নানান অঞ্চলে তাদের অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে তারা যে তাণ্ডব চালিয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের দুই নেতা আমু ও তোফায়েলের বক্তব্যই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার যে রাস্তাই গ্রহণ করা হোক না কেন সামান্য সুযোগেই তারা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।
কিশোর বালক থেকে শুরু করে সবাইকে রাষ্ট্র সম্পর্কে, দেশ সম্পর্কে, দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেওয়ার মাধ্যমে এমন একটি দর্শনের সৃষ্টি করা হয়েছে যা তাদের ভাষায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম করলেই দেশের সব অনিয়ম-দুর্নীতি শেষ হবে। এই দর্শনেরই পরিণতি আজকের পাকিস্তান। অর্থনৈতিকভাবে একটি অক্ষম দেশে পরিণত হয়েছে।
এখন আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে এই হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ করার, ইসলামের নামে ইসলামের ব্যবসা বন্ধ করার উপযুক্ত সময় এখনই। শক্ত হাতে এদেরকে যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে তাদেরকে হয়তো আর কখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এরা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পরে সমাজের ভিতরে লুকিয়ে পড়েছিল, তখনও এদের এই ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম করার স্বপ্নই ছিল । মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে তাদের সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায়। কিন্তু তারা আবার মাথাচাড়া দয়ে উঠেছে। এখন এদেরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে, যাতে আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এরা যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাকে পরাজিত করতে না পারে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক