‘ট্রাম্পইজম’কে কীভাবে মোকাবিলা করবেন বাইডেন?
সব শঙ্কাকে সরিয়ে দিয়ে নিরাপদেই সম্পন্ন হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান ঘিরে সারাবিশ্বের মানুষই গত কিছুদিন ধরে উদ্বেগের মধ্যে ছিল কারণ গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনের মতো এই দিনও তাণ্ডব চালাতে পারে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকরা এমন ইঙ্গিত দিয়েছিল ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন- এফবিআই। আর এই শঙ্কা থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছিল ৫০ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য যার মধ্যে শুধু রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির নিরাপত্তার জন্যই ছিল ২০ হাজার। ফলে কঠোর এই নিরাপত্তাবলয় ডিঙ্গিয়ে ট্রাম্পের উগ্র কোনো সমর্থক অনুষ্ঠান ঘিরে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটাতে পারেননি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন কমলা হ্যারিস। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী দীর্ঘকাল মার্কিন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ২০১৬ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন যিনি খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
চার বছরে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক সৃষ্টিকারী যে সমস্ত সিদ্ধান্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়েছিলেন ক্ষমতাগ্রহণের পর হোয়াইট হাউজের চেয়ারে বসে মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সেসব সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছেন জো বাইডেন। বাইডেন এই ধরনের ১৭ টি বিভিন্ন নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন যার মধ্যে রয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকান ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া সংক্রান্ত আইন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে ফেডারেল অর্থ ব্যয় করা, প্যারিস শান্তি চুক্তি তে ফিরে যাওয়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফিরে যাওয়া।
এই মুহুর্তে জো বাইডেনের সৌভাগ্য যে দীর্ঘকাল পরে মার্কিন সিনেট এবং মার্কিন প্রতিনিধি সভা ও প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে একই দলের দ্বারা নির্বাচিত। মার্কিন সিনেট যদিও একেবারে সমানভাবে বিভক্ত ৫০-৫০ আসনে কিন্তু তার ভাইস প্রেসিডেন্টের ভোট দেওয়ার ক্ষমতার কারণে সিনেটেও তারা মেজরিটি হিসেবে থাকছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্ত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দিয়েছেন বাইডেন, যা তার অভিষেক অনুষ্ঠানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। বাইডেন তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামা সবাই ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাদের গতকালের বক্তৃতায়।
কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের এক ঘণ্টার মধ্যে যে ১৭ টি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করলেন জো বাইডেন, তা মার্কিন সমাজকে কতটা ঐক্যবদ্ধ করবে সে প্রশ্ন সামনে এসে যায়। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সমস্ত পদক্ষেপগুলো তার দলের সেই উগ্র হোয়াইট সুপ্রিমেসি সমর্থক মানুষের কাছে সমাদৃত। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠা দেশ থেকে অভিবাসন স্থগিত করা, মেস্কিকো সীমান্তে দেয়াল দেয়া, এমনকি জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সবকিছুতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের সমর্থন পেয়েছে। সে কারণে বলা যায় যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলোকে রাতারাতি পাল্টে দেয়া জো বাইডেনের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে তা বোঝা যাবে পরবর্তী সময়ে।
যদিও জো বাইডেন তার কর্মকাণ্ডকে তার নির্বাচনী ওয়াদা বলে ঘোষণা করছেন, কিন্তু তার বাইরেও ভাবতে হবে ট্রাম্পের ৭৪ মিলিয়ন ভোটারের কথা। এই ভোটারদের জো বাইডেন কীভাবে জয় করবেন কিংবা নিজ দল ডেমোক্র্যাট পার্টিতে নানান ইস্যুতে বিরোধিতা কীভাবে মোকাবিলা করবেন তা এখন দেখার বিষয়।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে বাইডেনের সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়নে লড়া বার্নি স্যান্ডার্ড সিনেটে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেটর হিসাবে ভারমন্ট থেকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। বার্নির যে সমস্ত সোশালিস্ট রিফর্ম ধারণা তা সব সময় বাইডেনকে চাপে রাখবে। আবার অন্যদিকে বার্নির অংশের সক্রিয় সমর্থন বাইডেনকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে বাইডেনকে এটা ভুললেও চলবেনা।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল স্যান্ডার্সের সমর্থকদের পুরোপুরিভাবে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া। কারণ স্যান্ডার্স সমর্থক অনেকেই সেই সময়ে ভোটকেন্দ্রে যায়নি ফলে হিলারি ক্লিনটন খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।
জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্প উপস্থিত না থাকা বিষয়টা নতুন কিছু নয়। ইতিপূর্বে অনেক প্রেসিডেন্ট পরাজিত হয়ে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান দ্বারা প্রবর্তিত একটি প্রথা অনুসরণ করেছেন। তিনি বাইডেনের জন্য হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের টেবিলে একটি চিঠি রেখে গেছেন। তবে সেই চিঠিতে কী লেখা আছে তা গণমাধ্যম এখনো আমাদের জানাতে পারেনি। রিগ্যান থেকে পরবর্তী সকল প্রেসিডেন্টই এই প্রথা অনুসরণ করেছে। তবে এদের অনেকেই নতুন প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়েছেন। বাইডেনের শপথগ্রহণে ট্রাম্প উপস্থিত না থাকার কারণ, এ জন্য কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি। আগামী চার বছর ট্রাম্প, তার উগ্র সমর্থক, তার ভাবাদর্শ এবং সর্বোপরি 'ট্রাম্পইজম' যে বাইডেনকে নানাভাবে ভোগাবেন সেটিও অনুমেয়। এখন দেখার পালা, বাইডেন সেগুলোকে কীভাবে মোকাবিলা করেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক