অস্তাচলের গল্প
যখনই প্রিয় কোনো খেলোয়াড়কে মনে পড়ে, হারজিত আর পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে আমাদের চোখে তখন ভাসে কিছু মুহূর্ত। লিওনেল মেসির ক্ষেত্রে, আমার জন্য সেই মুহূর্তটা বায়ার্ন মিউনিখের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ওই সেমিফাইনাল। বোয়াটেংকে শুইয়ে দিয়ে এগিয়ে আসা ম্যানুয়েল নয়্যারের মাথার ওপর দিয়ে ডান পায়ে চিপ করছে বার্সেলোনার মেসি—ফুটবলে আমার দেখা সুন্দরতম দৃশ্য।
মেসি নিজেই এর চেয়ে ভালো গোল বহুবার করেছে। তবু যে মেসিকে মনে রাখতে গিয়ে ওই একটা ছবিই চোখে ফ্ল্যাশ মারে, তার কারণ সেই গোলের পরে ডাগআউটে দাঁড়ানো বায়ার্ন ম্যানেজার—মেসির প্রাক্তন বস—পেপ গার্দিওলার অভিব্যক্তি। পাগলে মতো হাত নাড়তে থাকা গার্দিওলার চোখে থাকল চূড়ান্ত হতাশা। আর থাকল একটা চিরন্তন সত্য: দৈব যদি সামনে দাঁড়ায়, নশ্বর মানুষ তখন কতটা অসহায়।
ফুটবলের নিয়মিত দর্শক জানে, লিওনেল মেসি মাঠে একরকম দৈবের মতোই। গড়পড়তা ভালো খেলোয়াড়ের কাছে যা অকল্পনীয়, তেমন বহু কিছু মেসি করে ফেলে জাদুকরেই মতোই আয়াসে।
সত্যি বলতে, দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুকরের সাথে মেসির একটা মিলও আছে। তাদের দুজনেরই বেড়ে ওঠা একই সময়ে। তাদের বেড়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের সাথে—যাদের কৈশোর নব্বইতে।
হ্যারি পটারকে যতদিনে দুনিয়া চিনতে শুরু করেছে, ফুটবল দুনিয়ার একটা অংশেও মেসির নামটা ততদিনে হয়ে উঠেছে পরিচিত। মেসি কে? দারুণ সম্ভাবনাময় এক ফুটবলার, বার্সেলোনার স্কাউট নাকি তাকে প্রথম দেখেই চুক্তি সই করে ফেলেছে একটা ন্যাপকিনে। হ্যারি পটার যখন পৌঁছে গেছে কুড়ির কোঠায়, বার্সেলোনার মূল দলের হয়ে তখন মাত্র মাঠে নামা শুরু হয়েছে মেসির। লোকে দেখেছে, রোজারিও থেকে আসা লম্বা চুলের একটা ছেলে, গোল করার পরে সে চড়ে বসে রোনালদিনিয়োর কাঁধে। পরের প্রায় দুই দশকে সেই ছেলেটা হয়ে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখের একটি, নীল-সাদা পলিথিন কেটে তার নামে জার্সি বানানো হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাগদাদ থেকে 'খেলা হবে'ময় বাংলাদেশে।
মেসি কে? দারুণ সম্ভাবনাময় এক ফুটবলার, বার্সেলোনার স্কাউট নাকি তাকে প্রথম দেখেই চুক্তি সই করে ফেলেছে একটা ন্যাপকিনে। হ্যারি পটার যখন পৌঁছে গেছে কুড়ির কোঠায়, বার্সেলোনার মূল দলের হয়ে তখন মাত্র মাঠে নামা শুরু হয়েছে মেসির। লোকে দেখেছে, রোজারিও থেকে আসা লম্বা চুলের একটা ছেলে, গোল করার পরে সে চড়ে বসে রোনালদিনিয়োর কাঁধে। পরের প্রায় দুই দশকে সেই ছেলেটা হয়ে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখের একটি, নীল-সাদা পলিথিন কেটে তার নামে জার্সি বানানো হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাগদাদ থেকে 'খেলা হবে'ময় বাংলাদেশে।
মেসি খেলেছে। স্পেনের নাগরিকত্ব না নিয়ে মেসি খেলেছে আর্জেন্টিনার হয়ে। সারা বছর বার্সেলোনায় থাকা ছেলেটাকে সহজে আপন করে নিতে পারেনি আর্জেন্টাইনরা, মেসি তবু খেলেছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নামের আরেক মানব-দেবতার সাথে জমে গেছে মেসির দ্বৈরথ। মেসি যদি পুরাণের গিলগামেশ হয়, তো রোনালদো এনকিদু। ফুটবলকে জিতিয়ে দিয়েই এরা দুজন খেলে গেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
মেসি জিতেছে। বেশি করে জিতেছে যখন সে খেলেছে বর্ষার দিনে স্কুলের ছেলেদের দাপাদাপি করার আনন্দ নিয়ে। কিন্তু মেসি হেরেছেও দেদার, বেশি করে হেরেছে চাপের মুখে।
মেসি খেলেছে, আর বিশ্বকাপের হাতছোঁয়া দূরত্ব থেকে ফাইনাল হেরেছে আর্জেন্টিনা। মেসি মিস করেছে পেনাল্টি কি টাইব্রেকার, আর্জেন্টিনা হেরেছে কোপার ফাইনালেও। মেসি কেঁদেছে, অবসরের ঘোষণা দিয়েছে আবেগে, তাকে নিয়ে ট্রল হয়েছে। কিন্তু শিল্পের জন্যেই শিল্পী শুধু বলে, লজ্জার মাথা খেয়ে মেসি আবারও ফিরেছে। আবার সে খেলেছে, মিস করেছে পেনাল্টিও। তার মাঝে 'মেসি একা কী করবে?'—চিৎকার হয়ে ওঠা কথাটাকে দমিয়ে মেসি চুপিসারে আর্জেন্টিনাকে একাকীই টেনে তুলেছে বিশ্বকাপ ফাইনালে (প্রায় দুইবার)!
কিন্তু হ্যারির কপালের কাটা দাগের মতোই, চিরকাল মেসির সঙ্গী হয়েছে অন্তহীন এক চাপ। প্রতিপক্ষের দুর্ভেদ্য ডিফেন্স বা ডাগআউটের কোনো মাস্টারমাইন্ড ট্যাকটিশিয়ান নয়, মেসির সত্যিকারের লড়াই চিরদিনই থেকে গেছে এক ঊনলৌকিক সত্তার সাথে: দিয়েগো ম্যারাডোনার মিথ। সেই ম্যারাডোনা, পপ-কালচারের বয়ানে যে লোকটা সারাজীবন কেবল জিতেই গেছে, অন্তত পেশাব করার আগ পর্যন্ত।
বস্তির পোলা ম্যারাডোনার সম্বল ঈশ্বরের নিজ হাতে তৈরি একটা বাম পা। কিন্তু পপ-কালচারে? ম্যারাডোনা মাঠে নামলে খেলায় জেতে, মারামারিতেও। ম্যারাডোনা পরোয়া করে না স্পেনের রাজার। ম্যারাডোনা নিজেই নাপোলির সম্রাট। ম্যারাডোনা খেলার চাইতেও বেশি কিছু। ম্যারাডোনা মানে আমেরিকার বিপরীতে দাঁড়ানো, ম্যারাডোনা মানে ফিদেল ক্যাস্ত্রো, ম্যারাডোনা মানে মাতারির পোলার পায়ে লাতিন আমেরিকা আর তৃতীয় বিশ্ব।
আর ঠিক এ জায়গাতেই লিওনেল মেসির পরাজয়। পাগলা হাওয়ার আশির দশকের বদলে মেসির সময়টা ডিপ্রেশনময় ফাইট ক্লাবের, অ্যাড্রেনালিনের বদলে তার দর্শকদের শরীরজুড়ে কেবল থাকে ডোপামিন। পপ-কালচারে ম্যারাডোনার মোজার প্রতিটি সুতো বুনে দিয়েছে বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ, কিন্তু লিওনেল মেসি? সে কেবল একটা কনটেন্ট, সে কয়েকটা মেগাবাইট ভিডিও, সে কেবল টিভির সামনে বসা একবিংশ শতাব্দীর একাকী মানুষের মুগ্ধতা।
লিওর যত অবাস্তব গোল, যত আধিভৌতিক কারিকুরি—সবটাই আমাদের ডোপামিন সমৃদ্ধ চোখে ধরা দেয় ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি নিয়ে। অন্যদিকে পুরাণে বর্ণিত দেবতার মতোই, খেলার মাঠে দিয়েগোর যেন পরাজয় নেই ইতিহাসে—বলা ভালো, ইউটিউবে। কিন্তু যদি আজ প্রতি মুহূর্তে ফুটেজে ধরা থাকত মানুষটার বুটের ধুলো আর চুলের ড্যানড্রাফ, যদি ফেসবুক আর টুইটারে মাদক বা নারী নিয়ে 'পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট' মন্তব্যের খাতিরে হ্যাশট্যাগ যুদ্ধে আমরা নিয়ত ধুয়ে দিতাম লোকটাকে, ভাবি, অলিম্পাসের চূড়া ছুঁয়ে আসা আসা হে ম্যারাডোনা; দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর—আপনি কি ভালো করতেন মেসি-রোনালদোর চাইতেও?
কিন্তু তবু, তবুও, লিওনেল মেসির সংজ্ঞা সবাইকে দিতেই হবে বিশ্বকাপ দিয়ে। হাজারো ম্যাচের মাঝে আমরা বেছে নেব কেবল সাতটাকেই।
এবার কি মেসি পারবে সেই কাহিনিটা পাল্টাতে? জানি না। শুধু জানি, বহু বছর পর, আগামী কোনো রাতজাগা বিশ্বকাপের মুহূর্তে, ক্ষণিকের জন্য টিভিপর্দায় দেখাবে একটা মানুষকে। সে হয়তো কোনো বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার, হয়তো নয়। কিন্তু তবুও তাকে দেখে আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা আঙুল তুলবে হ্যারি পটারকে দেখার মতোই উচ্ছ্বাসে। সেই উচ্ছ্বাস দেখে অন্য কোনো শিশু, বা কিশোর, বা তরুণ অবাক হবে। ছোটোখাটো সেই মানুষটার খেলা দেখতে চেয়ে তারা তখন চোখ রাখবে ইন্টারনেটে। এবং তারা চমকে যাবে আমাদের মতোই। পক্বকেশ আর জরাগ্রস্ত আমাদের তখন তারা জানবে—হ্যারি পটার নয়—লিওনেল মেসির প্রজন্মের মানুষ হিসেবে।
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে অমরত্ব নিয়ে এসেছিল গিলগামেশ, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওই সঞ্জীবনী লতা সে হারিয়েও ফেলেছে। গিলগামেশ জেনেছে, মানুষের জন্য অমরত্ব নয়।
একবিংশ শতাব্দীর সন্তান হিসেবে, সেই সত্য আমরা সকলেই আজ জানি। অমর গিলগামেশ নেই, তার গল্পটাই শুধু রয়ে গেছে আজ।
মেসি থাকবে না। কিন্তু তার গল্প থাকবে। বিশ্বকাপের সঞ্জীবনী লতা থাকুক, আর না থাকুক।
- সুহান রিজওয়ান: কথাসাহিত্যিক