আনন্দ-উৎসবে বছর বদলায়, কিন্তু আমরা আসলে বদলাই না
একটি শিশু একবার জানতে চাইল, 'আচ্ছা বলো তো আমার নামের মানে হচ্ছে হিংসা নাই যার, অথচ আমার তো মনে অনেক হিংসা। তাহলে এখন কী হবে?'
প্রশ্নটা শুনে খুব মায়া হলো। একটা ছোট মানুষ ওর মনের হিংসা নিয়ে ভাবছে, অথচ আমরা তো আমাদের মনের হিংসা নিয়ে ভাবি না। উপরন্তু হিংসা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি এবং হিংসার কারণে মানুষের ক্ষতি করছি।
জানতে চাইলাম, 'মা, বলো তো তোমার মনের হিংসাটা কেমন? কাকে হিংসা করছ?'
বলল, 'আমার কাজিনকে। ওর খালা বিদেশ থেকে একটা লাল ফোন এনে দিয়েছে। ওইটা দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়েছে। মনে হচ্ছে, ইস ওর আছে, আমারও যদি এমন একটা লাল ফোন থাকত! আর ও তো আমাকে ওই ফোনটা ধরতেও দিচ্ছে না।'
মনে মনে ভাবলাম, বাচ্চার মনের ভুল ধারণা ও কষ্টটা দূর করা উচিত।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আচ্ছা মামণি, বলো তো তোমার লাল ফোনটা নাই বলে কি ভাইয়ের লাল ফোনটা তোমার নষ্ট করে দিতে ইচ্ছা করে?'
ও বলল, 'না না, তা নয়। ওইরকম একটা লাল ফোন আমার শুধু পেতে ইচ্ছা করেছে। ভাই যদি ওরটা দিয়ে খেলতে দিত, তাহলেই আমি খুশি হতাম।'
বাচ্চাটিকে বললাম, 'তাহলে এটা তোমার হিংসা নয়। তোমার হিংসা আছে বলে তুমি মনখারাপ করো না। সব মানুষের মনেই ভালো কিছু পাওয়ার ইচ্ছা থাকে। কারও হাতে বা বাসায় সুন্দর কিছু দেখলে মনে হতেই পারে, ইস, আমারও যদি থাকত। কিন্তু হিংসা হবে তখনই, যদি মনে হয় ওর ভালো বা সুন্দর জিনিসটা আমার নাই বলে ওরটা নষ্ট করি বা ভেঙে ফেলি।
'আর এ-ও তো সত্যি, ভাই যদি তোমাকে ওর খেলনাটা দিয়ে একটু খেলতে দিত তাহলেই আর তোমার কষ্ট হতো না। কাজেই আমরা সবাই সব আনন্দ যদি ভাগ করে নিতে পারি, তাহলেই অন্যের মনের কষ্ট কমে যাবে।'
যে মেয়েগুলো কাজ করতে গ্রামের বাইরে যায় বা বিদেশে যায়, সেই মেয়েগুলো যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, তখন সেই মেয়েগুলোকে নিয়েই প্রচুর নিন্দা-মন্দ করা হয়। হিংসার বশবর্তী হয়েই মেয়েগুলোর চরিত্র হনন করা হয়, যেন এদের সবাই মন্দ বলে এবং এদের বিয়ে না হয়। কেন এই দরিদ্র মেয়েরা কাজ করতে বাইরে গেল, কেন এত আয় করলো, কেন নিজের পায়ে দাঁড়ালো কেন পরিবারের উন্নতি করলো, কেন ওরা আর দরিদ্র নয়, কেন আমরা এখনো দরিদ্রই থেকে গেলাম, তাই ওদের ক্ষতি করতেই হবে। পেছন থেকে ধরে টেনে নিচে নামাতেই হবে।
নতুন বছরের শুরুতে এই কথাটাই মনে এলো যে একটি শিশুর মনের এই 'হিংসা' জাগার প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে না কেন? কেন মনে হয় না অন্যের ভালো কোনো অর্জন দেখলে সেটা ধ্বংস না করে আমিও তেমন কিছু করার চেষ্টা করি? হিংসা মানুষের ষড়রিপুর একটি—এবং এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর রিপু। হিংসা থেকেই লোভ হয়, হিংসা থেকেই ধ্বংস করার ইচ্ছা জাগে। হিংসার কারণেই রাগ বাড়ে। এই হিংসার কারণেই অন্যের যেমন ক্ষতি হয়, পাশাপাশি নিজেরও মন ও শরীরের ক্ষতি হয়।
অথচ এরপরেও আমাদের, বিশেষ করে বাঙালিদের মনে হিংসা খুব বেশি পরিমাণে কাজ করে। যে কারণে সবক্ষেত্রে আমাদের ধ্বংসাত্মক কাজ বেশি হচ্ছে। প্রতিদিন খবরে দেখবেন কারো পুকুরে প্রচুর মাছের চাষ হয়েছে বলে বিষ দিয়ে সেই মাছ মেরে ফেলেছে তার প্রতিবেশী। অথবা হাঁস চাষ করে কেউ লাভের মুখ দেখছেন বলে তারই আরেক ভাই বিষ দিয়ে হাঁসগুলো মেরে ফেলেছে। শুধু কি তাই? ছোট ভাইয়ের বাচ্চা হয়েছে বলে হিংসায় বড় ভাই ও তার বউ মিলে নবজাতককে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।
কারও কলাবাগানে অনেক ফলন হয়েছে বলে এক রাতে পুরো কলা খেত কেটে তছনছ করে দিয়েছে বা গাছের সব আম পেড়ে নিয়ে গেছে—এমন ঘটনার খবর তো দেখছি হরহামেশা। এমনকি একদল পাখি সরিষা খেতে আসে বলে বিষ দিয়ে পাখিগুলোকে মেরে ফেলার ঘটনাও হরহামেশা ঘটছে।
গ্রামে প্রায়ই শোনা যায়, কোনো মেয়ের ভালো বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে কান ভাঙচি দিয়ে সেই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘটনা। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে বা কাজ করে টাকা আয় করেছে এবং সেই টাকা দিয়ে বাড়িঘর পাকা করেছে—ব্যস, তাতেই সর্বনাশ হয়ে গেল। সেই ব্যক্তির নামে মিথ্যা কথা রটিয়ে প্রায় একঘরে করে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
যে মেয়েগুলো কাজ করতে গ্রামের বাইরে যায় বা বিদেশে যায়, সেই মেয়েগুলো যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, তখন সেই মেয়েগুলোকে নিয়েই প্রচুর নিন্দা-মন্দ করা হয়। হিংসার বশবর্তী হয়েই মেয়েগুলোর চরিত্র হনন করা হয়, যেন এদের সবাই মন্দ বলে এবং এদের বিয়ে না হয়। কেন এই দরিদ্র মেয়েরা কাজ করতে বাইরে গেল, কেন এত আয় করলো, কেন নিজের পায়ে দাঁড়ালো কেন পরিবারের উন্নতি করলো, কেন ওরা আর দরিদ্র নয়, কেন আমরা এখনো দরিদ্রই থেকে গেলাম, তাই ওদের ক্ষতি করতেই হবে। পেছন থেকে ধরে টেনে নিচে নামাতেই হবে।
এই পা ধরে নিচে নামানোটা যে অন্যায় ও অপরাধ, হিংসা করা যে পাপ, এ কথাগুলো আমরা অনেকেই মেনে চলি না, আমাদের সন্তানদেরও শেখাই না। আর তাই শিশুরা অন্য বন্ধুর ভালো কিছু দেখলে মনঃকষ্টে ভোগে। এরাই বড় হয়ে অন্যের প্রাপ্তি কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
এই হিংসার পরিধি ব্যক্তি থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে সমাজে ও সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেকেই পছন্দ করেন না, এটা তাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পছন্দ। কিন্তু এই সরকারের সময়কালে করা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প, মধুমতী সেতু, ফ্লাইওভার এগুলো নিয়ে এত আজেবাজে সমালোচনা করেন যে শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এনারা সরকারের এই উদ্যোগগুলোকে হিংসা করেন। এই হিংসা আর কিছু নয়, এই হিংসা আমাদের পরিবার ও সমাজ থেকে পাওয়া অভ্যাস।
বাংলাদেশের মানুষ দিনরাত ধর্মের কথা বলে, বেহেশত-দোযখের চিন্তা করে, ওয়াজ শোনে, হারাম-হালাল নিয়ে ফতোয়া দেয়, নারীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। কিন্তু তারা কি জানে না যে, অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ নষ্টের চিন্তা ইসলাম সম্পূর্ণভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে?
এই যে আমরা বাংলাদেশের মানুষ এত দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছি যে ধর্মকর্ম, নীতি-নৈতিকতা, শাসন-শাস্তি কোনোটাই আর আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না, এর অন্যতম একটি কারণ লোভ। আর এই লোভ এসেছে হিংসা থেকে। ওর আছে, আমার নাই কেন? যেকোনো মূল্যে আমারও থাকতে হবে। আর অন্যের সম্পদ ও সম্মান আমার করার জন্য অন্যায় ও দুর্নীতি করতে মানুষের হাত কাঁপে না।
মানুষের চরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ খুব বেশি ক্ষতিকারক। এটি এমন একটি ব্যাধি যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে কুরে কুরে খায়। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তেমনি নিজের শরীর সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুচিন্তা, না পাওয়ার কষ্ট এবং অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা তাকে অসুস্থ করে তোলে।
বাংলাদেশের মানুষ দিনরাত ধর্মের কথা বলে, বেহেশত-দোযখের চিন্তা করে, ওয়াজ শোনে, হারাম-হালাল নিয়ে ফতোয়া দেয়, নারীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। কিন্তু তারা কি জানে না যে, অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ নষ্টের চিন্তা ইসলাম সম্পূর্ণভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে? পবিত্র কোরআনে সতর্ক করে আল্লাহ বলেছেন, 'আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সেজন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?' (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৪)
বিশেষ করে সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ মানুষের সব ভালো কাজকে নষ্ট করে দেয়। হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন 'তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।' (আবু দাউদ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, 'তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা এরূপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান করবে না, কারও গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করবে না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, পরস্পর হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে না, পরস্পর বিরুদ্ধাাচরণ করবে না, বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।' (বুখারি ও মুসলিম)। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখছি। কী পথে চলছি?
প্রতি বছরই আমরা নতুন বছরকে স্বাগত জানাই, আনন্দ উদযাপণ করি, ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখি, অন্যের মঙ্গল কামনা করি, পটকা, আতশবাজি, পার্টি, নাচ-গান করি। অথচ এগুলোর অনেক কিছুই করি শুধুমাত্র বাহ্যিক আনন্দলাভের জন্য। পরদিন আবার নেমে যাই সেই গৎবাঁধা জীবনযাপনে।
আচ্ছা, নতুন বছরে আমরা কি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এমন প্রতিজ্ঞা করতে পারি না যে আমরা আর অন্য মানুষের পেছনে কথা বলব না, অন্যের উন্নতি দেখে পেছন থেকে টেনে ধরব না, কারও সাফল্য দেখে মনখারাপ করব না, কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাব না, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার করবো না?
নতুন বছরে নিজেকে পরিবর্তন করা যায়, আরও ভাল কিছু করা যায়, সে কথা আমরা ভুলেই যাই। আর তাই বাংলাদেশের মানবিক উন্নয়ন হচ্ছে না। কারণ আমরা আদতে বদলাচ্ছি না। হিংসা, লোভ, অন্যের ক্ষতিসাধন ও অহংকার থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইনের 'মনোদর্পণ' নামে একটি গল্প এই লেখাটির সাথে যায় বলে উল্লেখ করছি। তরুণ ভিক্ষু সুরবজ্র নিজের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে আত্মপ্রশংসায় আপ্লুত হয়ে থাকেন। তিনি সুযোগ পেলেই ভিক্ষু কমলসম্ভবের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং নিজের জ্ঞান-গরিমা জাহির করেন। একদিন সুরবজ্র কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কমলসম্ভবকে আক্রমণ করে বললেন, 'সবাই আপনাকে একজন বোধিসত্ত্ব ভাবে, কিন্তু আপনি তা নন। আপনার মাথাভর্তি গোবর, আপনি আবর্জনার স্তূপের মতো সারা দিন অলসভাবে পড়ে থাকেন।'
কমলসম্ভব লজ্জা পেলেও উদাসীনভাবে সুরবজ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'প্রিয় সুরবজ্র, আমি কিন্তু তোমার মধ্যে স্বয়ং বুদ্ধকেই দেখতে পাই।' সুরবজ্র চতুর হাসি হেসে বিদায় নিলেন এবং বাড়ি ফিরে যাকেই পেলেন, তাকেই বলতে থাকলেন 'আজ কমলসম্ভবকে ধসিয়ে দিয়েছি।'
সুরবজ্র তার বোনকে ঘটনাটা বললেন। সব শুনে উত্তমা বললেন, 'না, ভ্রাতা, তুমিই বরং তার কাছে বাজেভাবে হেরেছ। কারণ, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তোমার স্বরূপটা কেমন। তুমি কি জানো না যে বাইরে তুমি যা দেখো, তা তোমার মনেরই ছবি। বোধিসত্ত্ব কমলসম্ভব যে তোমার মধ্যে বুদ্ধকে দেখেছেন, তার কারণ তিনি নিজে তাই। তুমি তাকে আবর্জনার স্তূপ হিসেবে দেখেছ, কারণ তোমার মনের মধ্যে ময়লার স্তূপ আছে।' সুরবজ্র নির্বাক হয়ে গেলেন।
আসলে মানুষের অন্তরের অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ মানুষের সব জ্ঞান ও সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দেয়। হিংসা একধরনের মানসিক রোগ। যারা হিংসুক, তারা কোনোভাবেই ইতিবাচক মানসিকতার হয় না। এরা নিজে যা, অন্যকেও সেইভাবে দেখে। কখনো অন্যের ভালো চাইতে পারে না।
উপনিষদের ভাষায় বলতে পারি—'তোমার কামনা যা, তোমার ইচ্ছাও তা-ই; তোমার ইচ্ছা যা, তেমনই তোমার কর্ম; তোমার কর্ম যা, সেটাই তোমার নিয়তি।'
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন