স্বাদু পানির যথেচ্ছ ব্যবহার: এক ফোঁটা পানির জন্য যুদ্ধ করে মরব?
২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া র্যাঙ্গো নামক সেই বিখ্যাত অ্যানিমেটেড মুভিটার কথা মনে আছে? মরুভূমির ভেতরে একটা গ্রাম যেখানে সপ্তাহে মাত্র একদিন পানি আসে। সেই পানি নিয়ে খুন পর্যন্ত হয়।
খুলনার দাকোপ উপজেলায় গিয়েছেন কেউ? অবস্থা সেই সিনেমাটার থেকে খারাপ। প্রায় পুরো দাকোপ জুড়ে আগে থেকেই গভীর নলকূপে মিষ্টি পানি ওঠে না। লাখো মানুষ পুকুরের পানি খেয়েই কোনরকমে চলত। কিন্তু অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ে নেমে আসে ২০০৯ সালের জলোচ্ছ্বাস আইলার পর থেকে।
জলোচ্ছ্বাসে সব পুকুরে নদীর লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় তা আর পানের উপযুক্ত থাকে না। সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এত বছর ধরে চেষ্টা করেও পরিস্থিতির বলার মতো কোনো উন্নতি করতে পারেনি। সারাবছর দশ কিলোমিটার দূরত্বের মাটির রাস্তায় হেঁটে প্রতিদিন পানি আনতে হয় — এরকম উদাহরণ আছে অনেক। এ দুর্মূল্যের বাজারে খাওয়ার পানি কিনতেও হয় অনেককে। গ্রামের একটা দরিদ্র পরিবারের জন্য মাসে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা শুধু পানির জন্য খরচ করা আসলেই অনেক কঠিন।
সেই হিসাব না হয় গেল প্রাকৃতিক দূর্যোগের অজুহাতে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মরুভূমিতেও পানির অভাব থাকবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু টলটলে মিষ্টি পানি যেখানে ছিল সে জায়গা আমরা মরুভূমি বানিয়ে ফেললে তখন? সিনেমা নয়, বাস্তবেই চলছে সেই মহাযজ্ঞ।
আমার এলাকা বটিয়াঘাটায় ৪৫০ ফুটের গভীর নলকূপ বসালেই দারুণ মিষ্টি পানি উঠত। সারাবছরই পাওয়া যেত সে পানি, খরার সময়ও কখনোই মিষ্টি পানির অভাব হয়নি। আজ শুনলাম আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ নলকূপেই আর পানি উঠছে না। নাহ, প্রাকৃতিক কারণে নয়, গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে আমরাই এ পরিস্থিতি তৈরি করেছি। কী কী করেছি আমরা?
শুরুটা করেছি ইচ্ছেমতো প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই গভীর নলকূপ বসিয়ে ফেলার মাধ্যমে। আমার ছোটবেলায় পুরো গ্রামে ৪০০ মানুষের জন্য আমি তিনটা মাত্র নলকূপ দেখেছি। টিউবওয়েল বসানো সহজ ছিল না তখন। নলকূপের পানি শুধু রান্না ও খাওয়ার জন্যই ব্যবহার করা যেত। গোসল, কাপড় কাচা বা অন্যান্য সব কাজ দিব্যি চলত পুকুরের মিষ্টি পানি দিয়ে। এরপর টিউবওয়েল সহজলভ্য হলো, নানান ধরনের এনজিও এল নলকূপ দিতে — আর কয়েক বছরেই প্রতি বাড়িতে গভীর নলকূপ বসে গেল। পুকুরের পানি মিষ্টি থাকা সত্ত্বেও কেউ আর সেই পানি ব্যবহার করি না।
শেষ পেরেকটা মারলাম শুকনো মৌসুমে বোরো ধান আর তরমুজ চাষ করতে গিয়ে। আমাদের এলাকায় খরার মৌসুমে আগে শুধু তিল আর মুগ ডালের চাষ হতো। এক ফোঁটা পানিও লাগত না সেচ হিসেবে। একটু লাভ করতে গিয়ে এখন হাজার হাজার একর তরমুজ চাষ হয়।
অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক দিতে দিতে ভালো খারাপ সব পোকামাকড় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে পরাগায়ন করার মতো কোনো পোকাও গতবছর অবশিষ্ট ছিল না। টাকা দিয়ে মৌমাছি কিনে এনে পরাগায়নের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে শেষে শ্রমিক নিয়োগ করে হাত দিয়ে পরাগায়ন করতে হয়েছিল চাষিদের।
এবার সে পরাগায়ন পর্যন্ত যেতে পারবে বলে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকারি খালগুলো ভরাট করে জমির পরিমাণ বাড়িয়েছের মালিকেরা সে অনেক আগেই। যে দুয়েকটা খাল অবশিষ্ট আছে, তার পানি অনেক আগেই শেষ হয়ে শুকনো খটখটে হয়ে যায়। সে কারণেই শুরু হয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ কাজটা, যেখানে সেখানে ডিপ বোরিং বসিয়ে খাবার পানির লেয়ার থেকে পানি তুলে চাষের জমিতে দেওয়া। খাবার পানির জন্য আগে এক ইঞ্চি পাইপের যে গভীর নলকূপ ছিল — সেখানে পাম্প লাগিয়ে পানি তোলা তো আছেই — সেই সঙ্গে যে যার মতো চার ইঞ্চি পর্যন্ত পাইপ লাগিয়ে পানি তোলার ঘটনা বেশ কয়কবছর ধরে চলছে। প্রতিটা মাঠে শয়ে শয়ে গভীর নলকূপ।
পাম্প বসালেই মাটির নিচ থেকে পানি উঠছে ঠিক আছে, কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। আমরা হয়তো বুঝছি না, বুঝলেও হয়তো প্রয়োজনের কাছে, অভাবের কাছে সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, পরে কী হবে সেই চিন্তা করে আজকের প্রয়োজন না মেটানোরে অবস্থা হয়তো আমাদের নেই। কিন্তু, এ ভালোমন্দ দেখার মতো কি কেউ নেই? থাকার কথা নয়?
২০১৮ সালের কৃষি কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন বলে একটা জিনিস দেখেছিলাম। তার প্রয়োগ, বাস্তবায়ন কারা করেন? এ সমস্যা সমাধানের উপযোগী কোনো আইন যদি নাও থাকে, আইনপ্রণেতারা সে রকম আইন কেন তৈরি করেন না? এ কৃষকেরা তাদের চাষের জন্য নিরাপদ পানি কোথায় পাবে তার ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয় না? এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পরে আমরা খাওয়ার পানি কোথায় পাব? এক ফোঁটা পানির জন্য যুদ্ধ করে মরব?