ইউক্রেনে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম গোলা পাঠানোর সিদ্ধান্ত পারমাণবিক ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলছে
ইউক্রেনে চ্যালেঞ্জার-২ মেইন ব্যাটেল ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা আগেই দিয়েছিল যুক্তরাজ্য; দিনকয়েক আগে এ ট্যাংকের জন্য বর্মভেদী ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম (ডিইউ) গোলা কিয়েভকে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। যুক্তরাজ্যের এ সিদ্ধান্ত একক নয়, বরং ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আব্রামস এম-১ ট্যাংক দিচ্ছে। তবে দ্রুত এসব ট্যাংক ইউক্রেনকে দেওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, সমাধান হিসেবে এর পুরোনো মডেলগুলো পাঠাবে ওয়াশিংটন।
আব্রামস ১২০ মিলিমিটার স্মুথবোর কামান-সজ্জিত। এ কামান দিয়ে চ্যালেঞ্জার ট্যাংকের মতোই ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম শেল ছোড়া যায়। ট্যাংকের চালানের সাথে বর্মভেদী এ শেলও কিয়েভকে দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম শেল বলতে এখানে বিশেষভাবে যে গোলার কথা বলা হচ্ছে, তাকে বলা হয় 'আর্মার পিয়ার্সিং ফিন-স্ট্যাবিলাইজড ডিসকার্ডিং স্যাবো' (এপিএফএসডিএস)। অনেকটা তীরের মতোই দেখতে এ গোলা আসলে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম, টাইটানিয়াম এবং মলিবডেনাম দিয়ে তৈরি বর্মছিদ্রকারী রড। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে গিয়ে যা শত্রুর সাঁজোয়া যানের বর্মভেদ করে এবং সেটিকে ধবংস করে।
কামান থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর শত্রুর ট্যাংকের বর্মে আঘাত হানার সময় ডিইউ স্যাবো রাউন্ড বাধা পেয়ে ভোঁতা হয় না, বরং সংঘর্ষে আরও ধারালো হয়ে প্রবেশ করতে থাকে। একইসঙ্গে এটি প্রচণ্ড দাহ্য, তাই ট্যাংক ধবংসে ডিইউ স্যাবো রাউন্ডের কদর রয়েছে সামরিক বাহিনীগুলোর কাছে।
তবে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ছাড়াও টাইটেনিয়ামের মতো অন্যান্য ধাতু দিয়ে এপিএফএসডিএস বর্মছেদকারী রাউন্ড প্রস্তুত করা যায়। তেজস্ক্রিয়তার কারণে রাশিয়ানরা ডিইউ শেলকে 'ডার্টি ওয়েপন' বলে ।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম খুবই ভারী ধাতু, যা পারমাণবিক জ্বালানি বা অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার একটি উপজাত। এটি সহজেই ইস্পাত ভেদ করতে পারে।
এ গোলা ব্যবহারের স্বপক্ষে দেওয়া যুক্তি হলো, ডিইউ প্রক্ষেপক মূল ইউরেনিয়ামের চেয়ে কম তেজস্ক্রিয় (যদিও তা খুব কম নয়)। তবে তারা এটা এড়িয়ে যান যে, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামকে খুবই ঘন করে পুরু বর্মভেদকারী স্যাবো রাউন্ড প্রস্তুত করা হয়।
জাতিসংঘের পরিবেশগত কর্মসূচি এ ধরনের গোলাবারুদকে 'রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় বিষাক্ত ভারী ধাতু' হিসেবে বর্ণনা করেছে। এ ধরনের গোলাবারুদের বিরোধীরা বলেন, এর তেজস্ক্রিয়তা দীর্ঘদিন ধরে মাটি ও বায়ুতে থেকে যায়, যা জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে, নবজাত শিশুদের বিকলাঙ্গতার এবং যেকোনো বয়সের মানুষের ক্যান্সারের কারণ হয়।
বৈজ্ঞানিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ডিইউ শেল আঘাত হানার সময় তেজস্ক্রিয় উপাদানের অজস্র সূক্ষ্মকণা তৈরি হয়। যা বাতাসে ভেসে আশাপাশের বহুদূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো নিঃশ্বাসের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে সেনাবাহিনীর সদস্য হোক বা বেসামরিক ব্যক্তি — কেউই এর বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত নন।
১৯৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধকালে ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ডিইউ শেল ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা। ইরাকের জনগণের পাশাপাশি এর তেজস্ক্রিয়তায় পশ্চিমা সেনারাও আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন যুদ্ধফেরত অনেক মার্কিন সেনা দীর্ঘদিন ধরে অবসাদ, তীব্র মাথাব্যথা, হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, বমিবমিভাব, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা ও স্মৃতিশক্তিহীনতার মতো সমস্যায় ভুগেছেন। সেনা চিকিৎসকেরা এর নাম দেন 'গালফ ওয়ার সিনড্রোম'।
ডিইউ গোলার কারণেই এসব উপসর্গ দেখা দেয় এমন প্রমাণও মিলেছে; যেমন এটি সেনাদের অস্থিমজ্জার (বোন ম্যারো) ঘনত্বকে ক্ষয় করেছে।
ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, বসনিয়া ও কসোভোয় ব্যাপকহারে ডিইউ শেল ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র; এদিক থেকে দেশটিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানই বলতে হয়।
১৯৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাত লাখ ৮২ হাজার ৩১৪টি ডিউ রাউন্ড ব্যবহার করা হয়। ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসনকালে তিন লাখের বেশি এ ধরনের গোলা নিক্ষেপ করা হয়। দুটি যুদ্ধেই অধিকাংশই গোলা ব্যবহার করে আমেরিকা।
ইরাকে অগণিত শিশু ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তায় শারীরিক বিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
অধিকারকর্মীরা ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি এ ধরনের অস্ত্র নিষিদ্ধ করার দাবি করে আসছেন, তবে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ট্যাংকে ব্যবহার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ভূমিতে হামলার জন্য তাদের এ-১০ ওয়ার্টহগ অ্যাটাক যুদ্ধবিমানের ৩০ মিলিমিটার জিএইউ-৮ অ্যাভেঞ্জার গ্যাটলিং কামানে ডিইউ গোলা ব্যবহার করে। এ-১০ যুদ্ধবিমানগুলো ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যাপকহারে ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত শীতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১০০ এ-১০ যুদ্ধবিমানের অনুরোধ জানিয়েছিল ইউক্রেন। এছাড়া এ বিমান পরিচালনার জন্য গোপনে প্রশিক্ষণও শুরু করেছে দেশটি। ক্রিমিয়ায় যদি আক্রমণ করা হয়, তাহলে এ-১০ ইউক্রেনে পাঠাতে পারে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। তখন হয়তো এ বিমানগুলো ইউক্রেনীয় পাইলট বা মার্কিন বিমানবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবী সাবেক পাইলটেরা এগুলো পরিচালনা করবেন।
এদিকে মার্কিন বিমানবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই এ-১০ যুদ্ধবিমানগুলোর ব্যবহার বন্ধ করতে চাইছে। তাদের মতে এ বিমানগুলো এখন স্নায়ুযুদ্ধের প্রতীক বই আর কিছু নয় এবং শক্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলো বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। সেদিক থেকে দেখলে, ইউক্রেনে এ বিমানগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার মানে হবে তাদের কাঁধ থেকে একটি অবাঞ্ছিত বোঝা সরে যাওয়া।
গত ১৪ মার্চ কৃষ্ণ সাগরে একটি এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ড্রোনটি কেবল একটি হান্টার-কিলার অস্ত্রই নয়, এটির জটিল ও অত্যাধুনিক সেন্সর ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কিত তথ্য সহজেই বের করা যায়। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে ক্রিমিয়া থেকে মাত্র ৩৭ মাইল দূরে রাশিয়ার নিষিদ্ধ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এ ড্রোনটি ব্যবহার করে রশিয়ান সেনা ইউনিটগুলোর বিষয়ে ইলেকট্রনিক ইন্টারসেপ্ট পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করছিল।
রাশিয়ার সুখোই-২৭ যুদ্ধবিমানের উপস্থিতিতে ওই ড্রোনটি কৃষ্ণ সাগরে ভূপাতিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র আবারও এ অপারেশন শুরু করছে বটে, তবে এবার তা করা হচ্ছে ক্রিমিয়া থেকে অনেক দূরে। আর ব্যবহার করা হচ্ছে আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক ড্রোন। এ ড্রোন দিনে ও রাতে যেকোনো আবহাওয়ায় নজরদারি পরিচালনা করতে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্র নিজের ড্রোনকে ক্রিমিয়ার এত কাছে পাঠানোর মানে হচ্ছে ইউক্রেন-ন্যাটো আক্রমণের একটি প্রস্তুতি চলমান রয়েছে। আবহাওয়া ঠিক হলে ও পর্যাপ্ত অস্ত্র হাতে এলে ইউক্রেনেকে ক্রিমিয়ায় আক্রমণ চালানোর পরামর্শ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো।
পুতিনের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনে যেন ঘৃণার কোনো সীমা নেই। সর্বশেষ তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাশিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সমর্থন করেছেন জো বাইডেন। আদালতের এ ত্বরিত আদেশের ফলে বাইডেন আর পুতিনের মধ্যে এখন আর কোনো আলোচনার দুয়ার খোলা থাকল না।
সর্বশেষ এসব ঘটনা নিয়ে রাশিয়া কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? পুতিন ইতোমধ্যে ডিইউ গোলা বিষয়ে ব্রিটেনকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে তার মনে কী রয়েছে তা এখনো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
ইউক্রেনের রণাঙ্গনে ডিইউ'র সূচনা করার মাধ্যমে ন্যাটো রাশিয়ার ট্যাক্টিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের মাধ্যমে জবাব দেওয়ার ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলল। রাশিয়া মনে করছে, পারমাণবিক প্যান্ডোরার বাক্স খোলার কাজটা করছে ন্যাটো।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।