ইউক্রেন যুদ্ধকে মাথায় রেখে বানানো হয়নি মার্কিন, ব্রিটিশ ও জার্মান ট্যাংক
জার্মান, ব্রিটিশ, ও মার্কিন মেইন ব্যাটল ট্যাংকের অনেকগুলো ইতোমধ্যে ইউক্রেনে পৌঁছে গেছে, বাকিগুলো সামনের দিনগুলোতে পৌঁছাবে। কিন্তু এসব ট্যাংকের সুপরিচিত কিছু দুর্বলতা আছে, আর খুব সম্ভবত রাশিয়ান বাহিনী এসব দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তার চেয়েও খারাপ দিকটি হলো, এসব ট্যাংকের কোনোটিরই সক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা অ্যাক্টিভ ডিফেন্স সিস্টেম নেই — হালের অত্যাধুনিক ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র থেকে ট্যাংক ও এর ক্রুদের নিরাপদ রাখতে যা অত্যন্ত জরুরি।
জার্মানির তৈরি ট্যাংকগুলো লেপার্ড নামে পরিচিত। ইউক্রেনে লেপার্ড ট্যাংকের দুটো সিরিজ পাঠানো হচ্ছে — পুরোনো ধরনের লেপার্ড-১ এ-৫ ও লেপার্ড ২ এ-৪ এবং এ-৬ ট্যাংক। লেপার্ড ২ সিরিজকে সবচেয়ে উন্নত ডিজাইনের ট্যাংকগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য তাদের কিছু আব্রামস এম-১ ট্যাংককে নতুন করে প্রস্তুত করছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এ ট্যাংকগুলোর ইউক্রেনে পৌঁছে যাওয়ার কথা। ব্রিটেন ইউক্রেনকে ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জার ২ ট্যাংক পাঠিয়েছে। ৬৯ টন ওজনের বিশাল এ ট্যাংকটি ইউক্রেনের অনেক ব্রিজ পার হতে পারবে না। এছাড়া দেশটির কাঁচা রাস্তাগুলোতেও এ ট্যাংক চলাচলের অনুপযুক্ত।
পশ্চিমা এ ট্যাংকগুলোর কোনোটিতেই রিয়্যাক্টিভ আর্মার (বর্ম) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। বরং এগুলো কেবল নন-এনার্জেটিক রিয়্যাক্টিভ আর্মার তথা নেরা নামক বিল্ট-ইন আর্মারে সজ্জিত। এ ধরনের আর্মার দুটো ইস্পাতের প্লেটের মাঝখানে ও অন্যান্য ধাতুর মিশ্রণে তৈরি করা হয়। শেপড চার্জ ও পেনিট্রেটর রড (বর্মভেদী দণ্ড) গোলা থেকে ট্যাংককে রক্ষা করার জন্য এ ধরনের আর্মারের নকশা করা হয়েছে।
কঠিন ইস্পাত, টাংস্টেন ও ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম থেকে পেনিট্রেটর রড তৈরি করা যায়। ব্রিটিশ ও মার্কিন ট্যাংকগুলোতে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম থেকে তৈরি আর্মার পিয়ার্সিং ফিন স্ট্যাবিলাইজড ডিসকার্ডিং সাবো (এপিএফএসডিএস) নামক পেনিট্রেটর রড গোলা ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম নিষিদ্ধ থাকায় জার্মান ট্যাংকগুলো টাংস্টেনের তৈরি পেনিট্রেটর ব্যবহার করে। ইউরোপীয় ও মার্কিন এ ট্যাংকের সবগুলোর মূল কামান ১২০ মিলিমিটারের স্মুদ বোর ব্যারেল। আর রাশিয়ান ট্যাংকগুলোতে সাধারণত ১২৫ মিলিমিটার স্মুদবোর গান ব্যবহার করা হয়।
রাশিয়ার মেইন ব্যাটল ট্যাংকগুলোর জন্য দেশটির কাছে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ও টাংস্টেন রডের গোলা রয়েছে। তবে রাশিয়া ইউক্রেনে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের গোলা ব্যবহার করছে না।
রাশিয়ান ট্যাংকগুলো নেরা প্রতিরক্ষার ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এসব ট্যাংকের কাঠামোর বাইরের অংশে চাহিদা অনুযায়ী এক্সপ্লোসিভ ও এনার্জেটিক রিয়্যাক্টিভ আর্মার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এসব আর্মার ট্যাংকের সামনে, টারেটে ও চারপাশের অংশে লাগানো হয়।
কনট্যাক্ট ১ থেকে কনট্যাক্ট ৫ পর্যন্ত ক্রমবিকাশ ঘটেছে রাশিয়ান রিয়্যাক্টিভ আর্মারের। বর্তমানে দেশটি রেকলিট নামক সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের রিয়্যাক্টিভ আর্মার তৈরি করেছে। এ আর্মারের নকশাই করা হয়েছে এপিএফএসডিএস গোলা প্রতিহত করার জন্য।
যখন কোনো গোলা ট্যাংককে আঘাত করে, তখন এক্সপ্লোসিভ আর্মার বিস্ফোরিত হয়। এ বিস্ফোরণ আগত গোলাকে হয় ক্ষতিগ্রস্ত করে, নয়তো অন্যদিকে সরিয়ে দেয়।
উন্নতমানের এক্সপ্লোসিভ আর্মারগুলো পেনিট্রেটর রডকে ভেঙে বা বাঁকিয়ে দিতে সক্ষম। রিয়্যাক্টিভ আর্মারকে এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে এটি বিস্ফোরণের সময় আশেপাশে থাকা সৈন্য ও অন্য যানবাহনের কোনো ক্ষতি না হয়।
ব্রিটিশ, জার্মান ও বিশেষত মার্কিনীরা দীর্ঘসময় মনে করেছিল তাদের ১৯৭০-৮০'র দশকে তৈরি করা ট্যাংকগুলোতে এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাক্টিভ আর্মারের কোনো দরকার নেই, কারণ এগুলো বেশিরভাগ ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম।
কিন্তু ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে সে হিসাব বদলে যায়। আইসিস কর্তৃক নিক্ষেপ করা রাশিয়ান ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে অনেক আব্রামস ও লেপার্ড (বিশেষত তুর্কি সেনাবাহিনীর লেপার্ড ট্যাংক) বিধ্বস্ত হয়।
মার্কিন ও জার্মান ট্যাংকগুলো যখন পুরোনো মডেলের রুশ ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সামনেই টিকতে পারেনি, তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল পশ্চিমা ট্যাংকগুলোর দুর্বলতা। আর রাশিয়াও জেনে গিয়েছিল তাদের ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে জার্মান লেপার্ড কতটা অসহায়।
২০১৭ সাল থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী আসন্ন গোলাকে ওপর বা নিচের দিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অ্যাঙ্গেলড টাইলস নামক নতুন এক ধরনের রিয়্যাক্টিভ আর্মার তৈরি করে। ২০১৯ সাল থেকে ইউরোপে মোতায়েন করা আব্রামস ট্যাংকগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতির পূরণের অংশ হিসেবে অ্যাঙ্গেলড টাইলস স্থাপন করতে শুরু করে।
মার্কিন আব্রামস ট্যাংকগুলোর সর্বশেষ সংস্করণগুলোতে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তৈরি ভিন্নধর্মী আর্মার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ সংস্করণের ট্যাংকগুলো ইউক্রেনে পাঠায়নি, কারণ দেশটির আশঙ্কা রাশিয়া তাদের এ নতুন আর্মার নকল করে নিজেদের মতো করে তৈরি করতে পারে।
এদিকে ইউক্রেনে নতুন আসা লেপার্ড ট্যাংকগুলোতে বাড়তি এক্সটার্নাল রিয়্যাক্টিভ আর্মার সংযুক্ত করছে ইউক্রেন। কিন্তু নিজেদের রিয়্যাক্টিভ আর্মার তৈরির কোনো ব্যবস্থা নেই দেশটির। আর তাই ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাশিয়ান ট্যাংকগুলো থেকে রিয়্যাক্টিভ আর্মার সংগ্রহ করে কাজ চালাচ্ছে এটি। সেক্ষেত্রে ধারণা করা যায় যে, ইউক্রেনের মোডিফাই করা লেপার্ড ট্যাংকগুলোতে নিদেনপক্ষে কনটাক্ট ১ রিয়্যাক্টিভ আর্মার যোগ করা হয়েছে।
এই যে ইউক্রেন তাদের 'নতুন' পশ্চিমা ট্যাংকগুলোতে এভাবে রিয়্যাক্টিভ আর্মার বসাচ্ছে, তা থেকে একটা কথা স্পষ্ট — এই নতুন পশ্চিমা ট্যাংকগুলো ইউক্রেনের পুরোনো ট্যাংকগুলোর চেয়ে কোনো অংশেই আহামরি উন্নত নয়।
ট্যাংকের অ্যাক্টিভ ডিফেন্স সিস্টেম ট্যাংকের দিকে আগত মর্টার, রকেট, ও গোলা সংঘর্ষ হওয়ার আগেই ধ্বংস করতে সক্ষম। এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি সবচেয়ে সফলভাবে কাজ করে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও মর্টারের বিরুদ্ধে। কিন্তু অন্য ট্যাংক থেকে নিক্ষেপ করা গোলাকে প্রতিহত করতে এটি অতটা পারদর্শী নয়, কারণ এ গোলাগুলো সুপারসনিক (মাক ৩) গতিতে লক্ষ্যের দিকে ছুটে যায়।
তাই আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে মোটামুটি বেশিরভাগ হুমকির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হলে একটি ট্যাংকের অতি উচ্চমানের আর্মার, রিয়্যাক্টিভ আর্মার, ও অ্যাক্টিভ ডিফেন্স সিস্টেম থাকা উচিত।
রাশিয়াও দাবি করেছে তাদের নিজস্ব এক বা একাধিক অ্যাক্টিভ ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনে ব্যবহার করা কোনো ট্যাংকেই এখন পর্যন্ত এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখা যায়নি। একইসঙ্গে জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনে পাঠানো কোনো ট্যাংকেও এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
বর্তমানে শ্রেষ্ঠ অ্যাক্টিভ ডিফেন্স সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের ট্রফি ও আয়রন ফিস্ট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পরীক্ষানিরীক্ষার উদ্দেশ্যে এগুলোর কেবল ১০০টির মতো ইউনিট সংগ্রহ করেছে।
দেশটির আব্রামস ট্যাংকগুলোতে তথাকথিত সফট-কিল অ্যাক্টিভ ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। এটি ট্যাংকের দিকে আসন্ন অস্ত্রের ইলেকট্রনিক্স জ্যাম করে দেয়। কিন্তু ট্যাংক ও আর্টিলারি থেকে নিক্ষিপ্ত গোলাগুলো মূলত গতিশক্তির ওপর ভর করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছুটে যায়। এসব গোলায় সেই অর্থে বিশেষ কোনো ইলেকট্রনিক্স নেই। অর্থাৎ সফট-কিল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অকার্যকর।
আর তাছাড়া ইউক্রেনে পাঠানো কোন আব্রামস ট্যাংকে সফট-কিল প্রযুক্তি থাকবে কি না তাও নিশ্চিত নয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।