বাখমুতের ফাঁদে ইউক্রেন, এই লড়াই রাশিয়ার অনুকূলেই কাজ করছে
পূর্ব ইউক্রেনের এক ছোট শহর বাখমুত, তবু এই শহর ঘিরে চলা লড়াই বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখেও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এই অদম্যতার মাধ্যমে তারা সেনাশক্তি পুনর্গঠন করে বহুল প্রত্যাশিত বসন্তকালীন আক্রমণ অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
বাখমুতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সুফল এখানেই শেষ ইউক্রেনের। কারণ সব লড়াইয়ের মতোই এই লড়াইও একটি সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছে।
বাখমুতে প্রতিরোধ গড়ার মাধ্যমে রাশিয়ান পক্ষের বিপুল সেনা ও সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতি তারা করতে পেরেছে। তবে বাখমুতের লড়াইয়ের পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। এখানে ইউক্রেনেরও বড় সংখ্যক সেনা হতাহত হয়েছে। আর রাশিয়া যত সহজে তার সেনাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে, সেটা করা ইউক্রেনের পক্ষে অসম্ভব।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর নাটকীয় পরিবর্তন
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সোভিয়েত মডেলেই পরিচালিত হয়েছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। বিশেষ করে, কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কাঠামো 'উপর থেকে নিচ' এই পদ্ধতি অনুসরণ করতো। এভাবে জুনিয়র অফিসার বা মাঠ পর্যায়ের উপ-অধিনায়ক ও সার্জেন্টদের ছিল না ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর সেনা কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। যাতে সহায়তা করেন পশ্চিমা প্রশিক্ষকরা, তারা মাঠ পর্যায়ের জুনিয়র অফিসারদের প্রয়োজন অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেন।
২০২২ সালে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে– যুদ্ধের ময়দানে এই কাঠামো বদলের ভালো সুফল পায় ইউক্রেন। ইউক্রেনীয় বাহিনী পায় সুবিধেমতো পদক্ষেপ নেওয়ার শক্তি। যুদ্ধের প্রথমদিকের লড়াইয়ে যা ইউক্রেনকে বেশ এগিয়েই রাখে। এসময় নিম্নপদস্থ সেনা অফিসার ও সার্জেন্টরা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহ অনুসারে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, ফলে তাদের অনেক অপারেশন সাফল্যের মুখ দেখে।
কিন্তু, এসব সাফল্যের নেতৃত্ব দেওয়া নিম্নপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ও সার্জেন্টদের অধিকাংশই হয় যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, নাহয় পেয়েছেন পদোন্নতি। ফলে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর কাঠামো এবং দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের লক্ষ্য এরপর আবারো বদলেছে।
ইউক্রেনের অন্তত এক লাখ ২০ হাজার সেনা সদস্য হতাহত হয়েছে। এদের পরিবর্তে যারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই সমমানের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা নেই।
সম্পূর্ণ বিজয় অর্জনের লড়াই
সেনাবাহিনীতে আসা এই পরিবর্তনের আঁচ লেগেছে ইউক্রেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রথমদিকে ইউক্রেনের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, যুদ্ধ অব্যাহত রেখে রাশিয়ার দ্রুত জয়লাভকে ঠেকানো। সেই লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছে।
ইউক্রেনের বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে সম্পূর্ণ বিজয়। এই জন্যেই সামরিক তাৎপর্য যতটুকু, ইউক্রেনের কাছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বাখমুতের লড়াই। প্রথমদিকে বাখমুতে অনেক রুশ সেনা হতাহত হলেও, এখন ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা ভারী হচ্ছে ইউক্রেনীয়দের। আবার রাশিয়ার রিজার্ভ সেনা সংখ্যার সাথেও ইউক্রেনের বিশাল ব্যবধান। ফলে বাখমুতের রক্তক্ষয়ী সংঘাত অব্যাহত থাকা আসলে রাশিয়াকেই লাভবান করছে।
বাখমুতে ইউক্রেনকে প্রধানত লড়তে হচ্ছে রাশিয়ার ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রুপের বিরুদ্ধে। যারা ব্যবহার করছে কারাবন্দিদের। ক্ষয়ক্ষতি হলেও হচ্ছে ওয়াগনারের, মূল রাশিয়ান সেনাবাহিনীর তেমন শক্তিক্ষয় হচ্ছে না।
এই বাস্তবতায়, বাখমুতে রক্তপাতে সবদিক থেকেই ইউক্রেনের ক্ষতি। উল্লেখযোগ্য হারে হতাহতের ভার বহনের সক্ষমতাও তাদের নেই।
যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়
উভয়পক্ষই নিচ্ছে বসন্তকালীন আক্রমণ অভিযানের প্রস্তুতি, ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেন – দুই পক্ষের কাছেই সেনা সদস্য ও গোলাবারুদ আরো মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছে।
বাখমুতে রাশিয়া স্বল্প-প্রশিক্ষিত ও হালকা অস্ত্র-সজ্জিত ওয়াগনার যোদ্ধাদের হারালেও – ইউক্রেন হারাচ্ছে সুপ্রশিক্ষিত সেনা, খরচ করতে হচ্ছে মূল্যবান গোলাবারুদ। ফলে যুদ্ধের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় –অর্থাৎ বসন্তকালীন অভিযানের ক্ষেত্রে রাশিয়া বাড়তি সুবিধা পাবে।
ওয়াগনার গ্রুপকে যুদ্ধেলিপ্ত রেখে ইতোমধ্যেই ৩ লাখ নতুন সেনার ভর্তি সম্পন্ন করেছে রুশ সেনাবাহিনী।
যুদ্ধের প্রথমদিকে রুশ সেনাবাহিনী বিপুল জনবল হারালেও, এখন ওয়াগনার গ্রুপকে যুদ্ধের সম্মুখভাগে রেখে নতুন সেনাদের প্রশিক্ষিত করার সময় পেয়েছে। যুদ্ধের প্রথমদিকে যেমনটা করা হয়েছিল – সেভাবে অবিচকের মতো স্বল্প প্রশিক্ষিত রুশ সেনাদের সরাসরি যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে না। বরং, তাদের প্রশিক্ষণ ও সঠিক অস্ত্র-সরঞ্জামে সজ্জিত করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় বিশ্বের কোনো সেনাবাহিনীই একই রকম থাকে না। সংঘাতের প্রয়োজন অনুসারে তাতে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি সক্ষমতারও পরিবর্তন হয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের ক্ষেত্রেই সেটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, যে সেনাবাহিনী পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে যুদ্ধের বিজয়তিলক তাদেরই হয়। তাই যেকোনো সফল সামরিক অভিযানের পূর্বশর্ত এভাবে পরিবর্তনের সামর্থ্য।
রুশ বাহিনীর শক্তিক্ষয় করায়, প্রাথমিক পর্যায়ে বাখমুতের লড়াইকে ইউক্রেনের জন্য কৌশলগত বিজয় হিসেবে দেখা হলেও এখন আর তা বলা যাচ্ছে না। তারপরও বাখমুতকে যেভাবে বড় গুরুত্ব দিয়েছে কিয়েভ, তাতে করে এখানে রুশ বাহিনীর আসন্ন বিজয়কে ইউক্রেনের বড় ধরনের পরাজয় হিসেবেই দেখা হবে।
বাখমুত নিয়ে ইউক্রেনীয় নেতৃত্বের গোঁড়ামি তাদের জন্য এক বোঝাই হতে চলেছে। যেমনটা প্রথমদিকে হয়েছিল রাশিয়ার জন্য। তবে রুশ নেতৃত্ব যুদ্ধের প্রয়োজন অনুসারে কৌশল নিতে পেরেছেন, সে তুলনায় ইউক্রেন যেসব সেনাদের হারাচ্ছে, তাদের ঘাটতি পূরণের উপায়ও তার নেই।