রাশিয়া-ইরান সামরিক মৈত্রী: পশ্চিমাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!
রাশিয়া আর ইরান সম্প্রতি তাদের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে বহুগুণে। এ দুই দেশের এমন গভীর সামরিক সহযোগিতা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এক প্রকার মড়াও উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই। রাশিয়া ও ইরান — উভয় দেশের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; কাজেই তাদের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা হওয়ার কারণ প্রথম দর্শনে বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু বিষয়টি আবার এত সরলও নয়। কারণ দমনমূলক রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সমাজে একঘরে থাকা দেশ হওয়া ছাড়া ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে মিল আছে কমই। তার ওপর রাশিয়ার আছে ইরানে আগ্রাসন চালানোর ইতিহাস।
রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও পারসিক সাম্রাজ্যের মধ্যে ১৬৫১ থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত পাঁচবার যুদ্ধ হয়েছে। পঞ্চম রুশো-পার্সিয়ান যুদ্ধের পর রাশিয়া ইরানের ট্রান্স-ককেশিয়া দখল করে নেয়। এ এলাকায় রয়েছে আজকের চেচনিয়া, দাগেস্তান, আজারবাইজান ইত্যাদি অঞ্চল, যা ঐতিহাসিকভাবে পারসিক সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে ইরানে অপারেশন কাউন্টেন্যান্স নামক সামরিক আগ্রাসন চালায়। ইরানের দুর্বল সেনাবাহিনী বাজেভাবে মার খায় সেই সময়।
পাহলভী আমলে মার্কিনঘেঁষা রাজাদের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক শীতল ছিল; যার সমীকরণ পালটে যায় ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবে। বিপ্লব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সাথে ইরানের সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয় — মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই পিলারের একটিকে গুড়িয়ে দেয়। বিপ্লবটি আফগানিস্তানের মতো ইস্যুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইরানের মধ্যে সহযোগিতার সুযোগও তৈরি করেছিল, যেখানে উভয় দেশই মার্কিন-সমর্থিত মুজাহিদীন বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নই সবার আগে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয় এবং ইরানের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌমত্বের অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে।
অন্যদিকে এ বিপ্লবের রেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে - এমন আশঙ্কাও করছিল দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র ইরাকের সাথে ইরানের দ্বন্দ্ব বাড়তে শুরু করে। একইসঙ্গে ইসলামিক রিপাবলিক অভ ইরানের জন্য নাস্তিক কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মিত্রতা ছিল অস্বস্তিকর।
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি সোভিয়েত-ইরান সম্পর্কের ইতিহাসে আরেকবার মোড় ঘোরায়। কমিউনিজমের পতন এবং মধ্য এশিয়া এবং ককেশাসে স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ইরান ও রাশিয়া উভয়ের জন্যই নতুন সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। বর্তমানে ইরান ও রাশিয়া অভিন্ন স্বার্থ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে, বিশেষ করে এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার এবং সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান এবং নাগর্নো-কারাবাখের মতো আঞ্চলিক সংঘাতের মতো বিষয়েও পারস্পরিক সহযোগিতা করছে।
কিন্তু এই সহযোগিতা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রূপ নেয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে। রাশিয়া ও ইরান উভয় দেশই বাশার আল-আসাদের পক্ষে ছিল; এবং সিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন — বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখা।
ইরানের কাছে সিরিয়া তার এক্সিস অব রেজিস্টেন্স-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ইরানকে ইরাক থেকে লেবানন পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার ও প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর শক্তি দেয়। অন্যদিকে রাশিয়া সিরিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাবের একটি মূল স্তম্ভ এবং ভূমধ্যসাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে দেখে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত রুশ-ইরানি সহযোগিতা সীমিত ছিল, কারণ তারা সিরিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অনুসরণ করেছিল। ইরান তার ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) এবং তার শিয়া মিলিশিয়াদের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে আসাদের বাহিনীকে স্থল সহায়তা প্রদানের জন্য; আর রাশিয়া তার কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে আসাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবগুলোকে স্থগিত করতে।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে আইআরজিসি কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি মস্কো সফর করেন এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করতে রাজি করান। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া আসাদের অবস্থানকে শক্তিশালী ও একটি রাজনৈতিক মীমাংসার পথ প্রশস্ত করতে বিশাল বিমান অভিযান শুরু করে; যা তারা করেছিল সন্ত্রাসবাদ দমনের ছুতায়।
রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ইরানের স্থল বাহিনীর সাথে সম্পর্কিত ছিল। রাশিয়া হিমিয়ামে একটি বিমানঘাঁটি এবং তারতুসে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করে সিরিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি সম্প্রসারিত করেছে। এই মৈত্রী বাশারকে ক্ষমতায় রেখেছে এবং ইরান ও রাশিয়া উভয় দেশকেই মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
তবে রাশিয়া-ইরান মৈত্রীর আসল গভীরতা অনুধাবন করা যায় ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন শুরু হবার পর। ইউক্রেনীয় বাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং পশ্চিমের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়ে সমর্থনের জন্য রাশিয়াকে তার মিত্রদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে; যার মধ্যে ইরান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জন কার্বির মতে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ইরান রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক মিত্র হয়ে উঠেছে। শাহেদ-১৩৬ সুইসাইড ড্রোন এবং মোহাজের-৬ রিকনেসেন্স অ্যান্ড স্ট্রাইক ড্রোনসহ শত শত ড্রোন দিয়ে ইরান রাশিয়াকে সাহায্য করেছে। এই ড্রোনগুলো রাশিয়া ইউক্রেনের সামরিক অবস্থানের পাশাপাশি বেসামরিক অবকাঠামো যেমন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সেতু, খেলার মাঠ এবং পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণে ব্যবহার করেছে। ইরান কাস্পিয়ান সাগরের মাধ্যমে রাশিয়ায় তিন লাখ আর্টিলারি এবং ট্যাংকের গোলা পাঠিয়েছে এবং অক্টোবর ২০২২ থেকে এপ্রিল ২০২৩ এর মধ্যে দশ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে।
অন্যদিকে ইরানের সামরিক সহায়তার বিনিময়ে, রাশিয়া ইরানকে ক্ষেপণাস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। ইরান কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রাশিয়ান যুদ্ধবিমান, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, রাডার এবং প্রশিক্ষণ বিমান কেনারও চেষ্টা করেছে। ইরানের পাইলটেরা ২০২২ সালের বসন্তে উন্নত যুদ্ধবিমান সুখোই সু-৩৫ ওড়ানোর জন্য রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার আক্রমণ টিকিয়ে রাখার জন্য পুতিনের কাছে ইরানের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইরান ড্রোন এবং গোলাবারুদ না দিলে রাশিয়া তার বিমান ও স্থল অভিযানে আরও সংকট এবং হতাহতের সম্মুখীন হতো। এর বিনিময়ে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের পক্ষে রাশিয়া সম্মতি দিয়েছে।
ইরানের সাথে রাশিয়ার এই দহরম-মহরম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র স্থানান্তরের জন্য দুই ডজনেরও বেশি ব্যক্তি ও সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ইরানের ড্রোন নির্মাতারা ও রেভল্যুশনারি গার্ডস অ্যারোস্পেস ফোর্স-এর পাশাপাশি রয়েছে রাশিয়ার কুখ্যাত ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপ।
ইরান অবশ্য রাশিয়ার কাছে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান দাবি করেছিলেন যে, তেহরান যুদ্ধের আগে 'সীমিত সংখ্যক' ড্রোন সরবরাহ করেছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ইরানি ড্রোন ব্যবহার করেছে এমন খবরকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন।
এ কথা বলা বাহুল্য, বর্তমান পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইরান ও রাশিয়ার এ সামরিক সহযোগিতার তাৎপর্য রয়েছে — বিশেষত পশ্চিমাবিশ্বের সবচেয়ে বড় জুজু এ দুই দেশের হাতে হাত মেলানো পশ্চিমাদের জন্য মারাত্মক মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। তবে দেশ দুইটির রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভিন্নতা রয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, পারমাণবিক চুক্তি এবং চীনের ভূমিকার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের ভিন্ন মতামত রয়েছে। তাই হয়তো ইরান ও রাশিয়ার যেকোনো সময় ওয়ারশ চুক্তির মতো আনুষ্ঠানিক সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা কম।
তা সত্ত্বেও অনানুষ্ঠানিক এ মৈত্রীর দ্বারা দুই দেশই তাদের সামরিক হস্তক্ষেপ, অ্যাসেমিট্রিক ওয়ারফেয়ার এবং কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ ও দুর্বল করছে। এই দুটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে পশ্চিমারা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারে তাও অনিশ্চিত এখন পর্যন্ত। তাই, পশ্চিমা দেশগুলো এবং পূর্বে তাদের মিত্রদের ইরান-রাশিয়া মৈত্রীকে অবমূল্যায়ন করা বা উপেক্ষা করা উচিত নয়, বরং এটিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং কার্যকরভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে।
ইরান ও রাশিয়ার জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং মানবাধিকারকেও সমর্থন করা উচিত, কারণ এই দুটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও বিরোধীমত দমন করে ক্ষমতায় আছে রাশিয়া ও ইরানের শাসকেরা। ইরান ও রাশিয়ার সামরিক মৈত্রী সম্পর্কে এখনই সচেতন হতে হবে; কারণ দুটি দেশই তাদের আঞ্চলিক হেজিমনি ধরে রাখার বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চাভিলাষ রাখে, যা সামনের দিনে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের জন্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।