কর্ণাটকের নির্বাচনের প্রভাব কি অন্য রাজ্যেও পড়বে?
আর কয়েক ঘণ্টা পরেই দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের রাজ্য কর্ণাটকের ভোট গণনা শেষ হবে। ক্ষমতার হাত বদল হবে, এমন ধারণাই উঠে আসছে ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর থেকে। রাজ্যটি বর্তমান কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির দখলে। রাজ্যটির ভোট গণনা আজ সকাল থেকে শুরু হওয়ার পরে ক্ষমতার হাত বদলের এই চিত্রই ফুটে উঠছে। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রে এগিয়ে আছে।
দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যটি প্রথমে মহীশূর রাজ্য নামে জন্ম লাভ করে ১৯৫৬ সালে, কিন্তু পরে ১৯৭৩ সালে নাম পাল্টে কর্ণাটক করা হয়। ভারতের সিলিকন ভ্যালি নামে খ্যাত এই রাজ্যটি শিক্ষায়, কৃষিতে, বৈদেশিক মুদ্রার আয়ে নেতৃস্থানীয় রাজ্য। রাজ্যটি বর্তমানে শাসক বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু রাজ্যটিতে কংগ্রেস তার হারানো রাজ্য ফিরে পাচ্ছে এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে ভোট বুথ ফেরত জনগোষ্ঠী। আজ ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল বিষয়টি।
এই রাজ্যে বাইরের তৃতীয় রাজনৈতিক দল হচ্ছে ভারতীয় জনতা দল, যার মূল নেতা হচ্ছেন একসময়কার ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া; এটি মূলত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। কিন্তু ক্ষমতার দাবা খেলায় কখনো কখনো কংগ্রেসের সঙ্গেও তাদের দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। এই রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, রাজ্যের কংগ্রেসের দলিত নেতা খড়গে সাত মাস আগেই সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেছেন । এক সযময়ের কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বহুল পরিচিত শশীথারুরকে নির্বাচনে পরাজিত করেছিলেন এই খড়গে। তার নেতৃত্বে ভারতের তিনটি রাজ্যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে কংগ্রেস। প্রথম ছিল গুজরাট যেখানে কংগ্রেস পরাজিত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হিমাচল, তৃতীয়টি এই কর্ণাটক।
হিমাচল প্রদেশের ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। বিজেপির শীর্ষ নেতা নাড্ডা। ২০২০ সালের নাড্ডাকে বিজেপির সভাপতি করা হয়েছিল অমিত শাহের পরিবর্তে। তিনিও হিমাচল প্রদেশেরই অধিবাসী। এ প্রদেশের নির্বাচনেও কংগ্রেস বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপির কাছ থেকে। আর এখন খড়গের নেতৃত্বে কর্ণাটকেও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
কর্ণাটকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্লোগান তুলেছিল 'জয় বজরংবলী'। এর পাশাপাশি কংগ্রেস তার নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপির যুব ফ্রন্ট বজরং দল ও একটি মুসলিম মৌলবাদী দল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে তারা ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে এই দুটি রাজনৈতিক দলের বিষয়ে তারা সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, অর্থাৎ দল দুটিকে নিষিদ্ধ করার কথাই প্রকারান্তে বলেছেন।
সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জয় বজরংবলী স্লোগান দিয়ে নির্বাচনের মাঠ দখল করতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন। কর্ণাটক রাজ্যটির ভাষা কন্নর ও ইংরেজি আবার এই রাজ্যের কিছু গ্রাম এখনো সংস্কৃত ভাষা চর্চা করেন। অর্থাৎ, দৈনন্দিন জীবনে ভাষা হিসেবে এখনও সংস্কৃতকেই বজায় রেখেছেন।
ভারতের জাতীয় লোকসভার নির্বাচন আগামী বছরের গোড়ার দিকে। সেই হিসেবে সময় এক বছরও নেই। এ সময়ে কর্ণাটকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বড় রাজ্যে কংগ্রেসের উত্থান বিজেপির পরাজয় জাতীয় ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবেই উঠে আসবে। কর্ণাটকের নির্বাচনের পর ভারতের আরও বেশ কটি রাজ্যে এই বছরের শেষে নভেম্বরের দিকে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যার বেশ কয়েকটিতে এখন বিজেপি ক্ষমতায়।
কর্ণাটকেন নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় হলেও ভারতের ২৮ টি রাজ্যের মধ্যে ১৭ টি রাজ্যে বিজেপি একক অথবা যুগ্মভাবে ক্ষমতায় থাকবে, কিন্তু হিমাচল ও কর্ণাটক রাজ্য নির্বাচনে পরাজয় আগামী লোকসভা নির্বাচনের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করবে তা এখন একটি বড় প্রশ্ন।
বিজেপির এই পরাজয়ে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় বৃহত্তর মোর্চা গঠনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে সর্বভারতীয় আঙ্গিকে সন্দেহ গভীর হয়েছে। বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সবাই তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির সহযাত্রী হিসেবেই বর্ণনা করছেন তাদের বক্তৃতায়। এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা সত্য হিসেবে উঠেও আসছে; যেমন- এই কর্ণাটকের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস একেবারেই নিশ্চুপ। মমতা ব্যানার্জি অসংখ্য রাজনৈতিক বক্তৃতা করেছেন এই সময়ে কিন্তু কোথাও এই নির্বাচন সম্পর্কিত কোন মত প্রকাশ করেননি।
মমতা ব্যানার্জির নাজেহাল অবস্থা চলছে তার নিজ রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিতে। কয়েক দিন আগে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল পশ্চিমবাংলার এ শাসক দলটিকে। কিন্তু গতকাল আবার কিছু নির্দেশনা তাদের অস্বস্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় পাঁচ বছর আগে মনোনীত ছত্রিশ হাজার শিক্ষকের মনোনয়নকে অবৈধ ঘোষণা করে দিয়েছেন, যা তৃণমূল কংগ্রেসের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতার পিছনে যে এই দুর্নীতি ভূমিকা রেখেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই এখন। ব্যাপকভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের চাকরি প্রদান করাই ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতার উৎস। বিরোধীরা এ কথাই বলছেন এখন। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশে একই ধরনের অভিযোগ কান পাতলেই শোনা যাবে। আগামীকাল সকাল নাগাদ কর্ণাটক রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হবে। দিল্লিতে কংগ্রেস তার বিজয় উৎসব করবে।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।