‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করা পশ্চিমাদের ব্যর্থতারই লক্ষণ’
জাপানের হিরোশিমায় জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করার বার্তা দেওয়া হয়েছে। এতে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের দৃঢ় সমর্থন অটুট রয়েছে বলেই প্রমাণ হয়। কিন্তু, একইসঙ্গে এটা তাদের ব্যর্থতারও প্রতীক। দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত।
রাশিয়া দ্রুত জয়ের আশা নিয়ে এই যুদ্ধে নেমেছিল। সে আশায় গুড়েবালি। আগ্রাসনের ঘটনায় পশ্চিমারা রুশ অভিজাতদের সম্পদ জব্দ করে, বাদ যায়নি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক সম্পদও। জ্বালানির জন্য রাশিয়ার বিকল্প উৎসের দিকেই ঝোঁকে তারা। যুদ্ধ-সরঞ্জাম তৈরি ও জ্বালানি শিল্পের দরকারি উপকরণ আর প্রযুক্তি যেন রাশিয়া না পায়- সে চেষ্টাও করা হয়েছে। কিন্তু, শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাই ক্রেমলিনের কর্তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মনোভাব বদলাতে পারেনি।
নিষেধাজ্ঞায় তাৎক্ষণিক কোনো সাফল্য না আসাটা অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষী এমন ঘটনা আগেও হয়েছে। খোদ প্রাচীন গ্রীসেই মেলে তার প্রমাণ। গ্রীস তখন বিভিন্ন ছোট-বড় নগর রাষ্ট্রে বিভাজিত। সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল এথেন্স ও স্পার্টা। এথেনিয়রা একটি জমিকে পবিত্র বলে মনে করতো। সেই জমিতে চাষাবাদ করা এবং এথেন্সের দূতকে হত্যা করার প্রতিবাদে তারা মেগারার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে। অবরোধ কাটিয়ে উঠতে এথেন্সের চির-প্রতিদ্বন্দ্বী স্পার্টার সাহায্য নেয় মেগারা। আর এভাবেই প্রাচীন ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী এক সংঘাত পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের সূত্রপাত হয় বলে জানা যায়।
সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে এভাবেই নিষেধাজ্ঞার মিশ্র ফলাফল দেখা গেছে। অর্থাৎ, কখনোসখনো সফল আর কখনোবা একেবারেই তা ব্যর্থ হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনীতিকে দমন করার চেষ্টায় মোটামুটি প্রভাব ফেলে নিষেধাজ্ঞা। আর তেমন ফলাফল আসতেও দীর্ঘসময় – কখনোবা কয়েক দশক লেগে যায়।
সন্দেহ নেই, রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার দংশন ঠিকই অনুভব করছে। কিন্তু, মস্কোর ওপর বিধিনিষেধ দেওয়ার ঘটনা পশ্চিমাদেরও ভোগাচ্ছে। পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা প্রায়ই বলেন, রুশ অর্থনীতি নাকি ভাঙ্গনের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অতিরঞ্জনের অন্যতম কারণ, তারা জানেন জ্বালানি, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনমানে পতনের মতো নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাবে ভুগছে তাদের অর্থনীতি। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ক্ষতিতে ভোটাররা চরম অসন্তুষ্ট। কিন্তু, রাশিয়ার অবস্থা আরো সঙ্গিন, এমন বার্তা দিতেই একথা বলা হয়।
তারপরও এটা ঠিকই যে, জি-৭ সদস্য দেশগুলোয় ইউক্রেনের প্রতি দৃঢ় জনসমর্থন আছে। রাশিয়ার আছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ আর প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা। এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা কতোটা কঠিন গত ১৫ মাসের ঘটনাপ্রবাহ তাই তুলে ধরে।
এই প্রেক্ষাপটে জি-৭ এর নেওয়া নতুন বিধিনিষেধ এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে ক্রেমলিন সমর উপকরণ কিনতে না পারে। একইসাথে, আগের নিষেধাজ্ঞাগুলোর যেসব ফাঁকফোঁকর ছিল সেগুলো বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাশিয়ান জ্বালানি নির্ভরশীলতা আরো কমানোর পদক্ষেপও নেবে জি-৭। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় মস্কোর অংশগ্রহণকে যতোটা সম্ভব দুঃসাধ্য করে তোলারও লক্ষ্য রয়েছে।
২০২২ সালের শুরুতে প্রাথমিক এক পূর্বাভাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, রাশিয়ার অর্থনীতি সাড়ে ৮ শতাংশ সংকুচিত হবে। পরে তা সংশোধন করে জানানো হয়ে- সংকোচন হবে মাত্র আড়াই শতাংশ। চলতি বছর রুশ অর্থনীতি শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে প্রাক্কলন করেছে আইএমএম। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বা মাত্র ২.৩ শতাংশে রয়েছে। সে তুলনায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরো অঞ্চল।
নিষেধাজ্ঞায় তাহলে কী হচ্ছে? এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, উপর থেকে দেখে যতটা ভালো বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে অবস্থা তার চেয়েও নাজুক। রাশিয়া থেকে দক্ষ কর্মীরা ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে এমন খবর প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। এই দুটি ঘটনাই অর্থনীতিকে রাতারাতি গুটিয়ে ফেলবে না, কিন্তু কোনো সুরাহা না করা হলে দীর্ঘমেয়াদে তা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এক পর্যায়ে অর্থনীতিকে মন্থর করেও ফেলবে।
যুদ্ধের প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েছে সেকথা রুশদের অনেকেই স্বীকারও করেন। যেমন গেল বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমির একটি সংস্থা – ইনস্টিটিউট অফ ন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরকাস্টিং জানায়, অর্থনীতির প্রায় সকল খাতেই পড়েছে নিষেধাজ্ঞার কালোছায়া। এরমধ্যে কাঁচামাল ও দরকারি যন্ত্রাংশ সংগ্রহকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, "সমস্যার তীব্রতা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ বেশ দ্রুততার সাথে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগামিতা রোধের পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। ব্যাংকিং খাতের আতঙ্ক রোধ করে তারা বাধাহীন একটি লেনদেন ব্যবস্থা চালু করেছেন এবং রুবলকে আগের (যুদ্ধপূর্ব) বিনিময় মানে ফিরিয়ে আনতেও সফল হন।"
এসব ধারণা শতভাগ গ্রহণযোগ্য নাহলেও – অর্থনৈতিক যুদ্ধের ফলাফল দ্রুতই পাওয়া যাবে বলে পশ্চিমাদের যে ধ্যানধারণা ছিল তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পশ্চিমারা প্রথমে মনে করেছিল, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার টাকাপয়সা দ্রুতই নিঃশেষিত হবে, ফলে সে সামরিক কাজে অর্থায়ন করতে পারবে না।
অথচ, পশ্চিমা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা রাশিয়ার রিজার্ভ সম্পদ জব্দ করা বা জ্বালানি নিষেধাজ্ঞার ফলে যে পরিণতির অনুমান করা হয়, কার্যত তা হয়নি। যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার সার্বিক তেল ও গ্যাস রপ্তানি কিছুটা কমলেও, বিশ্ববাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে রাজস্বের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
পশ্চিমা বিধিনিষেধ মোকাবিলায় রাশিয়া আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ে জ্বালানি বিক্রির প্রস্তাব দিয়ে, চীন ও ভারতের মতো অনেক ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে। এমনকী এপর্যন্ত মস্কোকে তার বর্তমান মুদ্রা রিজার্ভে হাত দিতে হয়নি। অবশ্য, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের বর্তমান পড়তি অবস্থা অব্যাহত থাকলে, হয়তো সেটাই করতে হবে।
পশ্চিমাদের দ্বিতীয় ধারণা ছিল, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেবে বিশ্ব সম্প্রদায়। এটাও অতি-আশাবাদ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দাজ্ঞাপনের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে।
ইউক্রেনের পক্ষে সর্বাঙ্গীন এই সমর্থন না থাকার ফলেই রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার নাগপাশকে সহজে এড়াতে পেরেছে। জার্মান সংবাদপত্র দ্য বিল্ডের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কাজাখস্তানে জার্মানির কার রপ্তানিই ৫০৭ শতাংশ বেড়েছে। আর্মেনিয়ায় রাসায়নিক পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১১০ শতাংশ। সেদেশে বৈদ্যুতিক ও কম্পিউটার পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩৪৩ শতাংশ।
রাতারাতি শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে কাজাখস্তান ও আর্মেনিয়ার এসব পণ্যের আমদানি বেড়েছে একথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং এগুলো রাশিয়ায় পুনঃরপ্তানি করা হচ্ছে এমন ব্যাখ্যাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।
পশ্চিমাদের সবশেষ ভ্রান্ত ধারণা ছিল, ১৯৮০'র দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয় আজকের রাশিয়ান ফেডারেশন। ফলে তলাবিহীন এই ঝুড়ি পশ্চিমাদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক চাপের মুখে নতিস্বীকারে বাধ্য হবে। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেমস গ্যালব্রেইথ উল্লেখ করেছেন, রাশিয়ার আছে চমৎকার শিক্ষা ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং শিল্প কারখানা – যার অনেকগুলোই স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর পশ্চিমা বহুজাতিক সংস্থার হাতে গড়ে ওঠা। এই প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার স্থানীয় শিল্পই লাভবান হবে। আমদানির সুযোগ কমায় সেসব পণ্যের বাজার ধরে ফেলবে রুশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
গ্যালব্রেইথ বলেছেন, '(উৎপাদনের) কিছু কারিগরি জ্ঞান এখনও রপ্ত করা বাকি রাশিয়ান শিল্পের। তবে এজন্য দরকারি উপকরণ – খাদ্য, জ্বালানি, বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলী মেধার অভাবও নেই রাশিয়ার। দেশটির অর্থনীতিকে নেতৃত্বদানকারীরা এসব সম্পদের যথাযথ ব্যবহার কতোটা করতে পারবেন- সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। কিন্তু, এপর্যন্ত তার বিপরীত ঘটার প্রমাণও সেভাবে মেলেনি।"
এসব ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাশিয়াই জয়ী হবে তা বলা হচ্ছে না। ভ্রান্ত ধারণার দায় পুতিনেরও আছে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, যুদ্ধ হবে সংক্ষিপ্ত, পশ্চিমারা খুবই সামান্য সমর্থন দেবে কিয়েভকে। কিন্তু, নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং যতদিন প্রয়োজন ততোদিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি ইঙ্গিত দেয়, জি-৭ যেমনটা ধারণা করেছিল তার চেয়েও অনেক বেশি দৃঢ় প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।
- লেখক: ল্যারি ইলিয়ট ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের অর্থনীতি-বিষয়ক সম্পাদক।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।